শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পথশিশুদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে

আব্দুল্লাহ আলম নুর | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৭ এএম

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। কিন্তু বাস্তবে কয়টি শিশু মাতৃক্রোড়ে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে? প্রতিদিন রাস্তার পাশে, রেল স্টেশনে, বাস টার্মিনালে, স্টেডিয়ামের পাশে, ফুটওভার ব্রিজে অনেক শিশুকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। কাগজ কুড়িয়ে, অল্প টাকায় ফুল বিক্রয় করে, অবহেলা, অনাদরে বেড়ে ওঠে তারা। পথ তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। তারা পথের পরিচয় বহন করে। আর্থ-সামাজিক নানা টানাপড়েনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই বঞ্চিত শিশুদের পরিচয় হয় ওঠে পথশিশু। বিষয়টি এমন নয় যে, তাদের পূর্বে কোনো পরিচয় ছিলো না। বরং তাদের কেউ উঠে আসে, পারিবারিক কলহ কিংবা বিচ্ছেদের কবলে পড়া পরিবার থেকে। কেউ পথে বের হয় অভাবের তাড়নায়। আবার কেউবা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে। কেউবা বের হয় প্রভাবশালীদের অত্যাচারে, শেষ সম্বল টুকুও হারিয়ে। তারপর তাদের থাকে না কোনো ঘরবাড়ি। থাকে না কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা। পথেই থাকে, পথেই ঘুমায়, পথেই নির্বাহ করে জীবিকা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখ। ২০০৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের শতকরা ৪১ ভাগ পথশিশুর ঘুমানোর বিছানা নেই; ৪০ শতাংশ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না; ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে, ৮৪ শতাংশ শিশুর শীতবস্ত্র নেই; ৫৪ শতাংশ শিশুর অসুস্থতায় দেখার কেউ নেই; ৭৫ শতাংশ পথশিশু অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে পারে না।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চরম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে পথশিশুরা। তাদের মধ্যে নেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা মাস্ক ব্যবহারের সঙ্গতি। এই সময়ে মানবেতর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে অনেক শিশু। কোনোকোনো পরিবারে বাবা-মায়ের কাজ চলে যাওয়ায় বা তাদের আয় কমে যাওয়ায়, খাবারের জন্য বের হতে হয়েছে পরিবারে থাকা শিশুকেও। আবার যে শিশুরা আগে কোথাও কাজ করত তাদেরও কাজ নেই, যার ফলে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খাদ্য ও কাজের সংকটেও পড়েছে তারা। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ‘স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক (স্ক্যান) করোনার শুরুর দিকে ৪৫২ জন পথশিশুর মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেছে নেয়া এই শিশুদের জরিপ থেকে জানা যায়, তাদের কেউই মাস্ক ব্যবহার করে না। তারা মনে করে, করোনা ধনীদের রোগ, এটা গরিবদের হয় না। করোনা সম্পর্কে অসচেতন এই শিশুরা নিয়মিত খাবারও পায় না। অনেকে খাবার বিতরণ করলেও পথ শিশুরা তা সবসময় পায় না। তাদের কাজ নেই। তাদের কেউ কোভিড আক্রান্ত কিনা তাও তারা বুঝতে পারে না। তারা মনে করে, সর্দি হয়েছে।’

পথশিশুদের নিয়ে অনেক সংগঠন মাঝেমাঝেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ঈদ, উৎসব, কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে কেউ তাদের নতুন পোশাক কিনে দেন, কেউ আয়োজন করেন হাতে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বা পিঠা উৎসবের, আবার কেউ খেলাধুলার আয়োজন করেন। কেউবা একবেলার জন্য খাবার ব্যবস্থা করে থাকেন। যদিও এসব ক্ষেত্রে পথশিশুদের সহায়তার চেয়ে, লোকদেখানো আর ছবি তোলার প্রবণতাই বেশি দেখা যায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে। দেখা যায়, এসবে পথশিশুরা দীর্ঘ মেয়াদে উপকৃত হয় না। যথাযথভাবে পুনর্বাসন না হওয়ায় তারা আবার আগের জীবনেই ফিরে যায়। তবে আশার কথা বর্তমানে কেউ কেউ পথশিশুদের জন্য স্কুল খুলে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছেন। অবহেলা, অনাদরে, খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটে পথশিশুদের। তারা সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেও। অনেক সময় বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। তাদের উপর চালানো হয় নানারকম নির্যাতন। কখনোকখনো বিভিন্ন অসাধু চক্র তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। তাদের অজান্তেই অপরাধীচক্রগুলো তাদের জড়িয়ে নেয় মাদকদ্রব্য পাচারের কাজে। এভাবেই অপরাধের বিস্তৃত জালে আটকা পড়ে, একসময় সেখান থেকে বের হওয়ার পথও খুঁজে পায় না তারা।

শিশুদের এসব অবক্ষয় থেকে দূরে রাখতে হলে সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। দৃঢ় করতে হবে পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে কলহ-বিবাদ নয় বরং সন্তানকে ভালোবাসতে হবে। সন্তানের সামনে তর্কাতর্কি না করে, উচ্চস্বরে কথা না বলে, প্রয়োজনে অন্য রুমে গিয়ে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিতে হবে। কারণ শিশুর সামনে রূঢ় আচরণ করলে, তার মধ্যে রূঢ়তাই বাসা বাঁধবে। অনেক বাবাই তার সন্তানের সামনে ধুমপান করে থাকেন। তাহলে সন্তান কোন স্বভাব লাভ করবে তার নিকট থেকে! তাছাড়া এতে যে তিনি নিজের পাশাপাশি সন্তানেরও ক্ষতি করছেন তা হয়ত জানা থাকা সত্তে¡ও বুঝতে পারেন না। সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে হবে। শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার পরিবার। কিন্তু সেই পরিবারে যদি সে অবহেলা বা নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সেখান সে ভালো আচরণ শিখবে না, সেখানে থাকতে চাইবে না। পরিবারকে হতে হবে শান্তিপূর্ণ। এর জন্য পরিবারে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে। সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ ছাড়াও আমাদের পথশিশুরা সবসময়ই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এমনকি বিশুদ্ধ পানি পানের নিশ্চয়তাও তারা সবসময় পায় না। শিশুদের দেহে বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগজীবাণু সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং সহজেই তাদের আক্রমণ করে। এছাড়া শহর-নগরের দূষিত ধোঁয়া ও ধুলাবালি শিশুদের নিউমোনিয়ার মতো ভয়ঙ্কর রোগের কারণ হতে পারে। অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধে মানবদেহ বিশেষত শিশুদের প্রয়োজন যথেষ্ট ফলমূল, শাকসবজি, ও সুষম খাদ্য। পথ শিশুরাও রাষ্ট্রেরই সন্তান, সমাজেরই সন্তান। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর উচিত লোকদেখানো আর ফটোসেশনের মানসিকতা পরিহার করে সত্যিকার অর্থে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজ করা।

পথ শিশুদের দেখলে তাদের সাথে রূঢ় আচরণ নয়, তাদের ঠেলে দেয়া নয় বরং তাদের সমস্যা শোনার চেষ্টা করতে হবে। নিজের সাধ্যমতো তাদের পরিবারকে সহায়তা করতে হবে। তাদের জন্য পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পথ শিশুদের ভালো রাখতে প্রয়োজন স্বদিচ্ছা। তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো শিশু যেন অবহেলা-অনাদরে ঝরে না যায়। ভালো থাকুক পথশিশুরা, তারাও বেড়ে উঠুক সুস্থ, স্বাভাবিক আর সুন্দর পরিবেশে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন