শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পথশিশুদের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে

আমজাদ হোসেন | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:২৭ এএম

পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ অক্টোবর আমাদের দেশে পালিত হয় ‘জাতীয় পথশিশু দিবস’। দিনটি পালন উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবছর পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, টকশোতে সমবেদনা ঝরে, এদের নিয়ে নানা পরিকল্পানা-পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। কিন্তু এর বাস্তবায়নের হার খুবই অপ্রতুল। পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মৌলিক অধিকারসহ স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে এসব কর্মসূচি বা পদক্ষেপ কোনো ফল বয়ে আনবে না। সরকারকে এখন এসব পথশিশুর কথা নতুন করে ভাবতে হবে।

ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নদীভাঙন, শৈশবে বাবা-মায়ের অকালমৃত্যুসহ নানা কারণে পথশিশু তথা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা একাধিক বিয়ে, পারিবারিক অশান্তি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে শিশুরা পরিণত হয় পথশিশুতে। বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই। তবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কয়েক লক্ষ পথশিশু রয়েছে। ফুটপাত, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক, লঞ্চঘাট, সরকারি ভবনের নিচে তাদের বাস। মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকে খোলা আকাশ। অবহেলা, অনাদরে, খেয়ে-নাখেয়ে তাদের দিন কাটে। এসব পথশিশু রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে, ফুল বিক্রি করে কিংবা কিছু খাবে বলে টাকা চায়। যে বয়সে তাদের হাতে থাকা উচিৎ বই-খাতা, সে বয়সে তাদের হাতে প্লাস্টিকের বস্তা অথবা ভিক্ষার থালা। জন্মের পরপরই তারা পৃথিবীর এক অন্যরকম চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। এসব ভাগ্যহীন, পরিচয়হীন শিশুদের আমরা কখনো টোকাই, কখনো পথকলি, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলে ডাকি।

জন্মের পর থেকেই পথশিশুরা জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশু পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানা রকম কাজ বেছে নেয়। হকার, শ্রমিক, রিক্সাচালক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, কুলি, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকম কাজ করে তারা। তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিপীড়ন চলে। মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে শিশুদের জাড়ানো হয়। মিছিল, মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে অহরহ পথশিশুদের ব্যবহার করা হয়। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তারা নানা ধরনের অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার।

জন্মের সময় প্রতিটি শিশু তার নাগরিক অধিকার নিয়ে জন্মায়। পথশিশুদেরও বাসস্থানের অধিকার রয়েছে, নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে, খাদ্যের অধিকার রয়েছে, শিক্ষার অধিকার রয়েছে। তারা কারও না কারও সন্তান, ভাই বা আত্মীয়-স্বজন। সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক জীব-মানুষ হিসেবে পথশিশুদেরও রয়েছে ন্যায্য অধিকার। স্বাধীন দেশে এ পথশিশুদেরও সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হওয়ার, বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু আমাদের দেশের পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই শিশুদের দিকে নজর বাড়ালে শুধু ঠিকানা বদল নয়, ওদের পুরো জীবনটাকেই পাল্টে দেওয়া সম্ভব।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব ভাসমান শিশুদের অবস্থান তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি পথশিশুর তালিকা তৈরি করতে হবে। তারপর তাদের উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করতে হবে। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মুক্তি-এসডিজির প্রধান লক্ষ্য, যা বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। দারিদ্র্য নির্মূলের পাশাপাশি আরও অনেক কাজ করতে হবে। পথশিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টিকর খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসতে হবে। তাদের সুশিক্ষা দিতে হবে। পথশিশুদের প্রতি নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ না থাকলে মানুষের জীবন বিপথে পরিচালিত হয়। তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে সমাজের মূলধারায় পুনর্বাসিত করতে হবে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীর বিশ্বকে এরাই নেতৃত্ব দিবে। এরাই হবে আগামী দিনের দেশ ও জাতির কান্ডারি। রাষ্ট্রের পাশাপাশি শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠনগুলো যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে এবং পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে তাহলে এ পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্য থেকেও আমরা পেতে পারি আগামী দিনের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ প্রভৃতি।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন