শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বন্ধ হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের নিয়ে অমানবিক পিংপং খেলা

প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ রেজাউর রহমান

মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিম বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব না দিয়ে তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেশত্যাগে বাধ্য করায় যে অমানবিক ও নিষ্ঠুর কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে তা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সামরিক বাহিনীর লৌহ শাসন থেকে মিয়ানমারের জনগণ মুক্তি পেলেও এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী অং সান সু চির দল কর্তৃক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও গত জুলাই মাসে কাচিন প্রদেশের হেপাকান্ড গ্রামে এবং মধ্য মিয়ানমারে দুটি মসজিদ আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়া হয়। পুনরায় যাতে মসজিদ দুটি নির্মিত না হয় সে লক্ষ্যেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। অগ্নিসংযোগের আগে বৌদ্ধদের ক্ষোভ থেকে মসজিদ দুটি রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণস্বরূপ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় যে বিরাট জনতার মারমুখী আচরণ মোকাবেলায় স্বল্পসংখ্যক পুলিশ যথেষ্ট না হওয়ায় তারা প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম ছিল।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকেই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ শুরু হয়। ১৯৯২ সালে রাখাইন প্রদেশ যেখানে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখান থেকে মিয়ানমারের বিশেষ বাহিনী নাসাকা এবং পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ থেকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার শিকার হতে শুরু করে নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ২০১২ সালে সংঘটিত হয় রোগিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা যাতে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে উস্কে দেয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে দেশ ছেড়ে আসা নিঃস্ব রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারে অবস্থিত দুটি উদ্বাস্তু শিবিরে ১ লাখ ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেলেও অনুমান করা হয় যে প্রায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বাইরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা বা স্বল্প বেতনে চাকরির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
এর প্রতিবাদে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সরকার সমস্যা শুরু হওয়ার সময় থেকেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে ন্যূনতম ৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান একটি বিরাট দায়িত্ব। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমস্যাটি নিয়ে সারা বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে না দেখে বিশ্ব সমাজ এটাকে আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি বলেই গণ্য করেছিল। কিন্তু পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার কর্তৃক সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ। দেশের অভ্যন্তরেও সমস্যা জর্জরিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বঙ্গোপসাগরে ছোট ছোট নৌকা বা ট্রলারে করে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি দেয়ার মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে কোনো দেশের উপকূলেই অবতরণ করতে না পেরে সমুদ্রবক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ পানীয় ও খাদ্য না পেয়ে বা উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবিতে সলিল সমাধি লাভ করতে বাধ্য হয়েছে। আরাকান বা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েমিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের অনেকেই ২০১২ সালের রোহিঙ্গাবিরোধী দাঙ্গার পরপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে সমর্থ হয়েছে। মিয়ানমার থাইল্যান্ড সীমান্ত পাড়ি দিয়েও অসংখ্য রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংলগ্ন সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছে।
থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় নয়টি আশ্রয় শিবিরে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার রোহিঙ্গা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনারের সাহায্য পেলেও শিবিরের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু মিয়ানমারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি অধিকাংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও রোহিঙ্গাদের মানবিক মর্যাদা দেয়া হয়নি। মিয়ানমারের তুলনায় যদিও থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়নি কিন্তু তাদের সহায়তা প্রদান করে চরম দারিদ্র্য থেকে তাদের উদ্ধার করার ব্যাপারেও সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব পরিলক্ষিত হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, থাইল্যান্ড থেকে রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট দলকে ছোট ছোট নৌযানে উঠিয়ে সমুদ্রবক্ষে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ১৯০ জনের একটি দলকে সামরিক নৌযান দিয়ে টেনে নিয়ে সমুদ্রে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত এ রকম একটি দলকে সমুদ্রবক্ষ থেকে উদ্ধার করার পর জানা যায় যে, সমুদ্রবক্ষে ঠেলে দেয়ার আগে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী তাদের শারীরিক নির্যাতন করেছে। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে জানা যায় যে, পাঁচটি নৌযানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওঠানোর পরে সমুদ্রবক্ষে ঠেলে দেয়া হয়। প্রবল ঝড়ের কবলে পরে এদের মধ্যে চারটি নৌযান ডুবে যায় এবং মাত্র একটি ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে পৌঁছায়। ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেÑ যখন তিনি বলেছিলেন যে, রোহিঙ্গাদের সমুদ্রবক্ষে ঠেলে দেয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে কোনো সহযোগিতা বা সমন্বয় ছিল না বা এখনও নেই। ২০১৫ সালের মে মাসে ধারণা করা হয় যে, ভাঙ্গাচোরা নৌযান নিয়ে অন্তত ছয় হাজার রোহিঙ্গা পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানি ছাড়া একেক দেশের উপকূল থেকে অন্যদেশের উপকূলে নামার চেষ্টা করে ব্যর্থকাম হচ্ছে। সমালোচকের দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে অসহায় মানুষ নিয়ে বিভিন্ন দেশের পিংপং খেলার শামিল; যাতে নিজেদের সমুদ্র উপকূলে নামতে না দিয়ে অন্য যে কোনো দেশের দিকে রোহিঙ্গাদের নৌযানগুলো ঠেলে দেয়া হয়েছে। সমস্যার গোড়ার দিকে অবশ্য এই সব দেশগুলো যথেষ্টসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। শরণার্থী আসা অব্যাহত থাকায় দেশগুলো কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। তার ওপর এসব দেশের কোনোটাই অবশ্য শরণার্থী সম্পর্কিত নীতিমালা অথবা কোনো দেশের নাগরিকত্ববিহীন জনগণ সম্পর্কিত জাতিসংঘের নীতিমালায় স্বাক্ষর করেনি। কাজেই শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা জনগণকে যথাযথ মর্যাদাদানে তারা বাধ্য নয়।
যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা সম্বন্ধে থাইল্যান্ড ও মালয়েশীয় সরকার দুটি উদাসীন, সেহেতু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাও ঘটে চলেছে। রোহিঙ্গাদের রক্ষা সম্পর্কিত কোনো আইন না থাকায় এটা সম্ভব হচ্ছে। অভিবাসী আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং রোহিঙ্গাদের নৌযানগুলোকে নিজেদের সমুদ্র উপকূলে ভিড়তে না দিয়ে অন্য দেশের উপকূলে ঠেলে দেয়ার ঘটনা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে তাদের ক্রীতদাসত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যথাযথ নাগরিকত্বের কাগজপত্র না থাকায় মিয়ানমারের সরকার ও জনগণের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে রোহিঙ্গা জনগণ কালোবাজারি বা মানব পাচারকারী দলের খপ্পরে পড়ছে। এমন সংবাদও পাওয়া গেছে যাতে জানা যায় যে, থাইল্যান্ড ও মালয়েশীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘটিত মানব পাচারকারী দলের যোগসাজশ রয়েছে এবং রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীগণ শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতির অভাবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের ব্যবসায়ীদের দ্বারা বিক্রয় হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গা মুসলমানরা হচ্ছে সর্বাপেক্ষা নির্যাতীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় ১৯৭৮ সাল থেকে মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন ও নিজেদের বসতি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর শাসনকালে ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় নাগরিকত্ব আইন। আইনে যারাই ১৮৮২ সালের পূর্বে তৎকালীন বার্মায় বসবাস করছিল তাদের বংশধরেরাই কেবল বর্তমান মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবেন। ১৯৮২ সালের পর থেকেই রোহিঙ্গাদের বিদেশি বসবাসকারী হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। দেশের অভ্যন্তরেও তাদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এমনকি তাদের দুই সন্তানের বেশি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। অনেক রোহিঙ্গা তাদের সন্তানদের জন্ম সনদপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে জন্মের সময় থেকেই তাদের কোনো দেশের নাগিরকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারের চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেয়া হলেও তারা যে মিয়ানমারে বা অন্য কোথাও জন্মেছেন অর্থাৎ তাদের কোনো জন্মস্থানের উল্লেখ না থাকায় তারা যে কোন দেশের নাগরিক তার প্রমাণ না থাকায় তারা কোনো দেশেরই নাগরিক নন বলে কোনো দেশেরই সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এমনকি মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও তাদের চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে রোহিঙ্গারা অভিবাসী শিবির বা বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য হন।
মিয়ানমার বা পূর্বতন বার্মা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকারের সার্বজনীন সনদ গৃহীত হলে তাতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে প্রথম ৪৮টি দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ২নং ধারায় যা বলা হয়েছে তা হলো ‘বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য ধরনের মতামত জাতীয় বা সামাজিক পরিচয়, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্য কোনো মর্যাদা নির্বিশেষে সকলেই সনদে বর্ণিত সকল প্রকার অধিকার বা মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী হবেন।’ এ ছাড়া সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৫নং ধারায় রয়েছে ‘কাউকেই বিনা দোষে নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহীন ব্যবহার বা শাস্তি প্রদান করা যাবে না।’ তবে ২০১৬ সালের এ পর্যন্ত মিয়ানমার অবশ্য বিনা কারণে অত্যাচার এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহীন আচরণ করা থেকে বিরত থাকার জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী নীতিমালায় অনুস্বাক্ষর করেনি। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে প্রতিটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার দ্বারা সরকারসমূহকে মানবাধিকার সনদের ধারাসমূহের লঙ্ঘন সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়। একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে এটা আশা করা সঙ্গত। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ওপর অনুষ্ঠিত সভায় সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বাহরাইনের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন যে, মিয়ানমারে নৃ-তাত্ত্বি¡ক গোষ্ঠীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং রোহিঙ্গা জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে ও তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সরাসরি ভুক্তভোগী বাংলাদেশ এসব আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে যথাযথ ভূমিকা পালনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
জাতিসংঘের কিছু সংখ্যক আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি মিয়ানমারের স্বীকৃতি থাকলেও অভ্যন্তরীণ আইন প্রণয়ন ও প্রচলনের দ্বারা মিয়ানমার সরকার সকল সংখ্যালঘু বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন করে চলেছে। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও অনুসরণের দ্বারা রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকার যথা শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও সুযোগ, চাকরির নিশ্চয়তা, বিবাহ ও প্রজনন অধিকার এবং চলাফেরা বা অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। বাধ্যতামূলক শ্রমদানেও রোহিঙ্গাদের বলপূর্বক নিয়োগ করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, একজন রোহিঙ্গা পুরুষকে প্রতি সপ্তাহে একদিন সরকারি বা সামরিক বাহিনীর কোনো প্রকল্পে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করতে হচ্ছে এবং প্রতি সপ্তাহে এক রাতে পাহারা দেয়ার কাজ করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কৃষিজমি সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করে অস্থানীয় বৌদ্ধদের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের যাতায়াত কেবল পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক নির্ধাতির এলাকার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত না এলে তাদের জেলেও যেতে হয়। এরপরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারাবাসের মেয়াদ শেষ হলেও তাদের পরিবারের কাছে ফেরত যেতে দেয়া হয় না। তাদের পরিবারের বাইরের কোনো এলাকায় থাকতে বাধ্য করা হয়। কোনো জরুরি প্রয়োজনেও নিজেদের এলাকার বাইরে যেতে হলে তাদের ভ্রমণ-অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় আর এসবই হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত যাতায়াত সংক্রান্ত অধিকারের নগ্ন লংঘন।
রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের বাসস্থান রাখাইন প্রদেশে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ এতই অপ্রতুল যে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার মাত্র ২০% শতাংশ। তার ওপর আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহকে রাখাইন প্রদেশে ঢুকতেই দেয়া হয় না যার ফলে স্থানীয়ভাবে রোহিঙ্গা জনগণ স্বাস্থ্য খাতে কোনো প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যমান তাই অনেক নিকৃষ্ট।
বিশ্বজুড়ে যে উদ্বেগ অতি সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে তা হচ্ছে মিয়ানমারে অতি নীরবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য একটি গণহত্যা কর্মসূচি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল আইন স্কুলের গবেষকগণ এ মর্মে অনেক প্রমাণ পেয়েছেন যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বহু যুগ ধরে মানবাধিকার লংঘিত হয়ে আসছে আর মানবাধিকার লংঘনের মাত্রা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেসব মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে গলা কেটে হত্যা বা শিরচ্ছেদ, ছুরিকাঘাতে হত্যা, অন্যান্য উপায়ে হত্যা, নিষ্ঠুরতম নির্যাতন করা ও গণগ্রেফতার। এছাড়াও রয়েছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ও গ্রাম অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা। আর এসবের জন্য কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক তথ্য সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনারের উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলোতে শৃঙ্খলার অভাবে প্রত্যাবাসনের গতি স্থবির হয়ে পড়ে। জাতিসংঘের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমারের অসহযোগিতার দরুন বিরাটসংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশে থেকে যেতে বাধ্য হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার থেকে তাদের কোনো প্রকার সাহায্য করা হয় না। বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রকার আর্থিক বা খাদ্য সাহায্য ছাড়া এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা না থাকায় শরণার্থী রোহিঙ্গাদের এক বিরাট সংখ্যা আরো দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে গভীর সমুদ্রে চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী নৌযান দিয়ে গত বছর অসংখ্য অভিযান চালাতে বাধ্য হয়। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সৃষ্টি হয় এক বিরাট অভিবাসী সংকট। মালয়েশিয়া সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের উপকূলে অবতরণ বন্ধ করে প্রায় আনুমানিক দেড় লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদানের পরে। থাইল্যান্ড থাই-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় নয়টি আশ্রয় শিবিরে ১ লাখ ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় প্রদানের পরে সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গাদের নৌযান তার উপকূল থেকে বিতাড়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ নৃশংস আচরণের নিন্দা জানায়, অসহায় সমুদ্রে ভাসমান বিপন্ন মানুষদের নিয়ে যেন পিংপং খেলা হচ্ছে এই মন্তব্য করে। অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মানব পাচারকারী দলগুলো। তারা নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নিঃস্ব রোহিঙ্গাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে তাদের বিক্রি করে অথবা বাধ্যতামূলক শ্রম শিবিরে নিয়োজিত করে। গত বছর দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ মানব পাচারকারীদের দ্বারা আনীত রোহিঙ্গাদের গণকবরের সন্ধানও পাওয়া যায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের উপকূলে শরণার্থী ভর্তি নৌকার অবতরণ বন্ধ করাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে বা উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গে নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যুবরণ করে। গত বছরের মে মাসে ধারণা করা হয় যে, সমুদ্রে চলাচলের অনুপযোগী নৌযানে যথেষ্ট খাদ্য ও পানীয়ের মজুদ ছাড়া ছয় হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমুদ্রে ভাসমান ছিল যাদের অধিকাংশই কোনো দেশে আশ্রয় পায়নি।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চির দল জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেও সরকারি নীতির পরিবর্তন আশা করা যায় না। নির্বাচনের আগে বৌদ্ধ জনগণ ও বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিরক্তি এড়ানোর লক্ষ্যে সু চি রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনো মন্তব্য করেননি এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় আমাদের দেশকে ভালোবাসে না। নির্বাচনের পরে সরকারি বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য কোনো বিশেষত্ব ধরা পড়ে না।
কাজেই নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের সরকারি নীতির ফলে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়বেÑ এটাই ধারণা করা বাস্তবসম্মত হবে।
 লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন