বল উড়ে গিয়ে যদি বিল্ডিংয়ে লাগে তাহলে আউট। আর মাটিতে ড্রপ করে গেলে চার। দৌড়ে একরান, দুইরান নেওয়ার সুযোগ আছে, এভাবেই আমরা খেলি। খেলার নিয়ম জানতে চাইলে এভাবে ব্যাখ্যা করলেন গলির ক্ষুদে ক্রিকেটার ইয়াসিন। উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র এই ইয়াসিন। তার মতো রিয়াদ, শাওন, মনিররা স্কুল বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই মেতে উঠে গলির ক্রিকেটে। আর তাদের খেলার দর্শকও শিশু-কিশোররা।
গতকাল স্কুল প্রাঙ্গণের কিছুটা সামনে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। রাজধানী ঢাকার প্রতিটি স্থানে সবুজ মাড়িয়ে গড়ে উঠছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। বিস্তৃত কোন খোলা জায়গা না থাকায় গলিই শিশু-কিশোরদের কাছে খেলার মাঠ। রাজধানীর অধিকাংশ মাঠ নানাভাবে দখল হয়ে পড়েছে। মাঠের অভাবে খেলতে না পেরে শিশু-কিশোররা এখন টেলিভিশন ও মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে। এতে অনেকে মানসিকভাবে অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়ছে।
রাজধানীর সর্বত্রই এমন সীমাবদ্ধতার চিত্র। সরেজমিনে বেশ কিছু এলাকা ঘুরে চোখে পড়েছে খেলার মাঠের জন্য হাহাকার। অবারিত খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। যা আছে তা একবারেই নগন্য। গত কয়েকদিন রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ ও মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি মাঠ ঘুরে দেখা যায়, তরুণদের ১০-১২টি দল আলাদা হয়ে এক মাঠে খেলছে। খেলার সময় এক দলের বল যাচ্ছে আরেক দলের কাছে। এ নিয়ে তর্কও হচ্ছে যথারীতি। তবে তারা জানালেন, পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় বাধ্য হয়েই এখানে এসেছেন। খেলার সুযোগ পেতে সকাল থেকেই শুরু হয় জায়গা দখল।
মহাখালীর সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালের পাশেই ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) মাঠের জায়গায় হচ্ছে নতুন আবাসিক ভবন, রাজধানীর তেজকুনীপাড়া খেলাঘরের অর্ধেক মাঠ দখল সরকারি কাজে, বিজি প্রেস মাঠ বন্ধ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য তেজগাঁও এলাকার ‘খেলাঘর সমাজকল্যাণ সংঘ’ মাঠের অর্ধেকাংশ সরকারের আওতায় চলে যায়। এতে বন্ধ হয়ে যায় খেলার মাঠ।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠের একাংশে তৈরি হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার ও জিমনেশিয়াম। এতে কমেছে মাঠের পরিধি। সঙ্কুচিত হয়েছে এলাকার তরুণদের খেলাধুলার সুযোগ। এছাড়া পুরান ঢাকার শহীদ আব্দুল আলীম মাঠ, বাংলাদেশ মাঠ ও শহীদনগর মিনি স্টেডিয়ামে একের পর এক গড়ে উঠেছে বহুতল অট্টালিকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব খেলার মাঠগুলোতেও গড়ে উঠেছে ভবন। অবশিষ্ট মাঠগুলোতেও খেলাধুলার পরিবেশ নেই বললেই চলে। অনেক মাঠে শোভা পাচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। সরঞ্জাম রেখে দখল করে রাখা হয়েছে মাঠ। খেলার মাঠে গড়ে উঠছে বসতঘরও। মাঠে জমে আছে ময়লা আর্বজনা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে খেলার মাঠ ও পার্ক আছে ৬৯টি। এরমধ্যে ডিএনসিসি এলাকায় এই সংখ্যা ৩৪টি (নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ড বাদে) ও ডিএসসিসিতে ৩৫টি। ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা শহরে জনগনের আধিক্য এবং জায়গার সঙ্কটের কারনে প্রয়োজনের তুলনায় মাঠ এমনিতেই কম আছে। নতুন যে ১৮টি ওয়ার্ড আছে সেখানে খেলার মাঠ ও অন্যান্য জিনিস অর্ন্তভুক্ত করে আধুনিক টাউন গড়ার জন্য প্লান করে কাজ করছি। কিন্তু যেখানে ঘনবসতি সেখানে ইচ্ছা করলেই একটা খেলার মাঠের জায়গা বের করা যাবে না। ঢাকা শহরে এত জায়গা বের করা কঠিন, তারপরও যেখানে উন্মুক্ত জায়গা আছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) তাদের খেলার মাঠগুলোকে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন সেখানে সহযোগিতা করছে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ইনকিলাবকে বলেন, প্রায় প্রতিটা ওয়ার্ডে সরকারি জায়গা আছে এবং সেগুলো দখলে। কোন জায়গা আমরা দখল হতে দেবো না। দখলকৃত জায়গা উচ্ছেদ করে খেলার মাঠ করা হবে। কমলাপুরের টিটি পাড়ায় যে জায়গা আছে তাতে ৩-৪টি স্টেডিয়াম করা যাবে। গরুরহাট বসে ও অন্যান্যভাবে সেগুলো দখল করা হয়েছে। যদি এই জায়গাগুলো জনকল্যাণে ব্যবহারের অনুমতি দেয় তাহলেতো হবে। লক্ষীবাজারে মেয়র একটি মাঠ দখলমুক্ত করেছেন। বহু বছর আগে এক লোক লিজ নিয়েছিল গাড়ি পার্কিয়ের জন্য। প্রায় ২০ বছর আগে। গাড়ি পার্কি করতে না দিলে সে কোর্টে গিয়ে একটা স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে, যাতে উচ্ছেদ না করে। এই ১২ বছর সে স্থগিতাদেশ দেখিয়ে দখল করে রাখল। সেই জায়গাটা আমরা এবার বের করলাম। এভাবেই বের হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: নাঈম আকতার আব্বাসী ইনকিলাবকে বলেন, খেলার মাঠ না বাচ্চাদের থাকায় মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এরুপ অবস্থা বিরাজ করলে একটি বাচ্চার মানসিক গঠনটা যেমন হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে যখন সে অ্যাডাল্ট হবে তখন কিন্তু তার পরিবেশের সাথে অ্যাডজাষ্ট করাটা মুশকিল হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন পরিবেশে সে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না। মনের ভেতর চাপ পড়ে, একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়; আলটিমেটলি কিন্তু মানসিক সমস্যা হতে পারে। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার হতে পারে, অ্যাডজাস্টমেন্টের ডিসঅর্ডার হতে পারে।
ধানমন্ডির বাসিন্দা ইমরান মাহমুদ করোনাকালীন সময়ের মধ্যে তার চার বছর বয়সী ছেলে আফিফকে নিয়ে বের হতে পারেননি। এলাকায় মাঠ সঙ্কটের কারনে নিজে একটু উন্মুক্ত জায়গায় হাঁটা-চলা করতে পারেন না। তিনি বলেন, এলাকায় মাঠ না থাকায় সরকারি কলোনীর সংরক্ষিত যে ছোট বিনোদন পার্ক, সেদিকেই এলাকার ছেলে-মেয়েরা শরীর চর্চার জন্য ভীড় করে। তবে ইদানীং কলোনীর বাসিন্দা ছাড়া সেখানেও প্রবেশ করা যাচ্ছে না। সুস্থ বিনোদনের অভাবে আমার ছেলে এখন টেলিভিশন ও মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে। এতে প্রায় সময়ই দেখি চোখে ব্যাথা অনুভব করে। না দিয়েও পারি না। করবেটা কি? এই সমস্যা শুধু ইমরানেরই নয়। পুরো রাজধানীবাসীর।
এছাড়া মাঠের অভাব ও করোনাকালীন সময়ে ইন্টারনেটে বেশি ঝুঁকছে স্কুল-কলেজগামী ছেলে-মেয়েরা। এক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন ডা: নাঈম আকতার আব্বাসী। এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, মাঠের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মোবাইল, ইউটিউব, ফেসবুক ছাড়াও বিভিন্ন ইন্টারনেট কন্টেন্টে ঝুঁকছে। আর গত দেড় বছরে করোনাকালীন সময়ে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় সারাদিনই বাচ্চারা অনলাইনে বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখছে। ভালো-খারাপ দু’টোই আছে। সেখানে নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে অভিভাবকদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। এছাড়া খেলার মাঠ না থাকায় ইনডোর গেমসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। খোলা পরিবেশে যে প্রভাবটা তার মনের ওপরে পরার কথা তা কিন্তু পড়ছে না।
খেলার মাঠ নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সর্বশেষ এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় প্রতি ১২ হাজার মানুষের জন্য অন্তত ৩টি খেলার মাঠ প্রয়োজন। কিন্তু এর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ‘ঢাকা শহরে বিদ্যমান খেলার মাঠের ঘাটতি ও চাহিদা পর্যালোচনা’ শীর্ষক বিআইপির গবেষণা বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯২টি ওয়ার্ডে (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো ছাড়া) সরকারি-বেসরকারি মোট ২৩৫টি খেলার মাঠ আছে। কিন্তু সব মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। সর্বসাধারণ ব্যবহার করতে পারে এমন মাঠ আছে মাত্র ৪২টি। ১৪১টি মাঠ আছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায়, কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি। ১৬টি সরকারি মাঠ বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে।
বিআইপির নগর পরিকল্পনা গ্রহন করে সম্প্রতি ওয়ার্ড ভিত্তিক মাঠ করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, উত্তর সিটিতেও এমনই হওয়া দরকার। জনবসতিপূর্ণ ঢাকায় জায়গার সঙ্কট আছে এবং প্রয়োজনে অধিগ্রহনের পরামর্শ তার। এই নগর বিশেষজ্ঞ ইনকিলাবকে বলেন, খেলার মাঠ ছাড়া নগর পরিকল্পনাই সম্ভব না। পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকলে ঢাকায় এত হাসপাতালের প্রয়োজন হতো না। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ যে হারে প্রয়োজন তার ধারে কাছেও নেই ঢাকা। বরং যাও ছিল দখল হয়ে যাচ্ছে। মাঠের জন্য প্রয়োজনে জায়গা অধিগ্রহন করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের জন্য ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা (খেলার মাঠ, পার্ক, শিশুপার্ক, ঈদগাহ ইত্যাদি) প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় জনপ্রতি খোলা জায়গার পরিমাণ এক বর্গমিটারেরও কম। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের মানসিক-শারীরিক বিকাশ ও সুস্থ বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ জরুরি। অথচ রাজধানীতে খেলার মাঠ, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানের খুবই অভাব।
তবে আশা দেখাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ। ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন উন্মুক্ত স্থানসমূহের আধুনিকায়ন উন্নয়ন ও সবুজায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উত্তর সিটির ১৮টি পার্ক ও ৪টি খেলার মাঠের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন অর্ন্তভুক্ত। এর অনেকদূর এগিয়েও গেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেকগুলো পার্ক আমরা উন্নয়ন করছি। ২৩টি পার্ক আমরা শীঘ্রই উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে উদয়াচল পার্ক উদ্বোধন করেছি। শাহাবুদ্দিন পার্ক উদ্বোধন করেছি। ঢাকা শহরের শাহাবুদ্দিন পার্ক ও উদয়াচল পার্ক বাস্তবেই ঘুরাঘুরির জন্য চমৎকার জায়গা। ২৩টি পার্ক যদি উন্মুক্ত হয়ে যায়, খেলার মাঠগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে নগরবাসী উপকৃত হবে। কিন্তু খেলার মাঠ আরো হওয়া দরকার।
এদিকে গতকাল নগরীর ডেমরাস্থ ৬৮নং ওয়ার্ডের করিম জুট মিলস মাঠে আন্ত:ওয়ার্ড ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফুটবল খেলা পরিদর্শন শেষে গনমাধ্যমকে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমাদের ছেলেরা যেন মাঠে ফিরে আসে, খেলাধুলা করে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, প্রতিটি ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত খেলাধুলার জায়গা নেই। আন্ত:ওয়ার্ড ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সাথে সাথে আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলাধুলার জায়গা সৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
নগরবাসীরা জানাচ্ছেন, শহর যত ঘিঞ্জি হচ্ছে, ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে, খেলার মাঠের সমস্যাটা ততই প্রকট হচ্ছে। মাঠ না পেয়ে তরুণরা খেলছে বাড়ির ছোট্ট গ্যারেজে কিংবা বাসার ছাদে। মাঠের অভাবে তারা চার দেওয়ালকেই বেছে নিচ্ছে।
ঢাকার দুই সিটিতে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। তবে বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই নেই খেলার মাঠ। ডিএনসিসির ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মতিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, শুধু খেলার মাঠ নাতো, কবরস্থান বানানোরও জায়গা নেই। খেলার মাঠ নেই, কমিউনিটি সেন্টার নেই, বিনোদনমূলক কোনকিছুই আমাদের এলাকায় নেই, ঈদগাহ নেই। আমার ওয়ার্ডে কোন খাস জমি নেই। আমার ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, কবরস্থান বা কমিউনিটি সেন্টার করার মতো কোন জায়গা নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন