বর্তমান যুগ, তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তি সবকিছু এনে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়। মানুষের বিকল্প এখন এসব প্রযুক্তি। একসময় মানুষ দিয়ে যা যা করতে হতো, এখন তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সেসব সহজেই করা সম্ভব। যেন মানুষের বিকল্প প্রযুক্তির উদ্ভাবিত বিভিন্ন সামগ্রী। প্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের জীবনযাপন সহজ করেছে, অন্যদিকে আমাদের আবেগ-অনুভূতিকেও নষ্ট করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় সবার হাতে হাতে নানা ধরনের ডিভাইস রয়েছে। এতে মানুষ ধীরে ধীরে সব কাজে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। স্মার্টফোন বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এক অনন্য ‘উপহার’। বর্তমান সময়ে এমন মানুষ কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যার কাছে স্মার্টফোন নেই। এটি আমাদের যেমন উপকারী করছে, তেমনি কেড়ে নিচ্ছেও আমাদের অনেক কিছু। তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় মানুষের মুঠোফোনের ওপর নির্ভরশীলতা বর্তমান সময়ে আসক্তির মতো হয়ে গেছে। এই মুঠোফোনের প্রভাব সবসময় একমুখী হয় না। তবে ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মন-মেজাজ মুঠোফোন ব্যবহারের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে। কথা বলা, খুদে বার্তা প্রেরণ ছাড়াও এমন কোনো কাজ নেই যা মুঠোফোনে করছে না। মুঠোফোন জীবনের অন্যতম কয়েকটি অনুষঙ্গের একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে মুঠোফোনের আসক্তি মানসিক স্বাস্থের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে; এমনকি মাননিকভাবে অসুস্থ করে ফেলছে ব্যবহারকারীকে। কিংস কলেজ লন্ডনের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ আসক্তিমুলক আচরণের অর্থ তারা যদি মুঠোফোনে সব সময়ের জন্য হাতে না পায় তাহলে তারা আতঙ্কিত বা বিচলিত হয়ে পড়ে। তরুণরা মুঠোফোনের পেছনে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে তারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জরিপে সতর্ক করা হয়েছে, এ ধরনের আসক্তি গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নিতে পারে। গবেষণাটি বিএমসি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর আচরণ কোনো ধরনের আসক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, তাদের মধ্যে ফোন ব্যবহার করতে না পারায় উদ্বেগ কাজ করে, মোবাইলের ব্যয় করা সময়কে তারা সংযত করতে পারে না এবং মুঠোফোন এত বেশি ব্যবহার করা হয় যে, এটি অন্যান্য কাজকর্মের ক্ষতি করে। বর্তমানে বাংলাদেশে অসংখ্য শিশু মুঠোফোনে অতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছে। এতে শুধু তাদের চোখের ক্ষতিই নয়, সামগ্রিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অনেক মা-বাবা শিশুদের খাওয়ানোর সময় মুঠোফোন ব্যবহার করেন। এই সময়টা শিশুরা নিষ্ক্রিয়ভাবে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। মা-বাবা ও সন্তানেরা একসঙ্গে থাকার সময়ও প্রত্যেকেই নিজের মুঠোফোনে ব্যস্ত এ দৃশ্য সাধারণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি থেকেও পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ব্যাপারটি উদ্বেগজনক।
২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য স্ক্রিনে কাটানো সময়, বসে থাকা কমানোসহ পর্যাপ্ত ঘুম এবং সক্রিয় খেলায় বেশি সময় দেওয়া-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে। এক বছর বয়স পর্যন্ত স্ক্রিন টাইমের (টেলিভিশন, ভিডিও বা ইন্টারনেটে কিছু দেখা) কোনো প্রয়োজন নেই। দুই থেকে চার বছর বয়সীরা দিনে সর্বোচ্চ এক ঘন্টা স্ক্রিনে সময় কাটাতে পারে, তবে কম হলে ভালো হয়। সব বয়সী শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম এবং খেলাধুলা প্রয়োজন। আমরা মনে করি, শিশু এবং তরুণদের মধ্যে মুঠোফোনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুরা ফোনে কতটা সময় ব্যয় করছে অভিভাবকদের তা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। শিশুদের মুঠোফোন-আসক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন হওয়া এবং এর প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রযুক্তি ভালো বা খারাপ নয়। আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি, তার ওপর নির্ভর করে এটি আমাদের জীবনের জন্য কল্যাণকর হবে কি না। মুঠোফোন দিয়ে যদি কোনো কাজ দ্রুত করা যায় বা এর মাধ্যমে যদি সন্তানদের সঙ্গে একত্রে কোনো কিছু উপভোগ করা হয়, তাহলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তাই সম্ভব হলে ছেলে-মেয়ের বয়স ১৮’র আগে স্মার্টফোন নয়।
ডাঃ মাওঃ লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবাইল : ০১৭১৬ ২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন