আহমেদ জামিল
গত ১ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতি এবং এর পাশাপাশি ভারতের আগ্রাসী তৎপরতা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের সাথে ১৯ দফা কর্মসূচি যুক্ত করে এই দিনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিএনপি দক্ষিণপন্থি, বামপন্থি ও মধ্যপন্থি সকল দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী দল ও ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক ঐক্য ও মিলনের প্লাটফর্মে পরিণত হয়। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা দলটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিতে মূল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
আওয়ামী লীগের ভারতপন্থি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপরীতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপি। তবে দল হিসেবে বিএনপির চলার পথ কখনো মসৃণ ছিল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত, প্রতিষ্ঠাকালের ৩৮ বছরের মধ্যে দলটি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, অব্যাহত সর্বমুখী চাপ, নেতা-কর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম- নির্যাতন, হত্যা, গুম এবং হামলা-মামলার কারণে প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে বিএনপিকে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়ে যখন এগোচ্ছিলেন সে পটভূমিতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে তিনি শহীদ হন।
তার শাহাদতের পর বিএনপি সাংগঠনিকভাবে সর্বপ্রথম সংকটের মুখোমুখি হয়। কিন্তু শহীদ জিয়ার পতœী বেগম খালেদা জিয়া সংগঠনের দায়িত্বভার গ্রহণের পর বিএনপি দ্রুত সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে। দলের ৩৮ বছরের ইতিহাসে ৩৪ বছর ধরে বেগম খালেদা জিয়া শক্ত হাতে বিএনপির হাল ধরে রেখেছেন। এই ৩৪ বছরে এরশাদের সামরিক শাসন এবং ১/১১’র প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে বিএনপিকে। তবে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে শাসনকালের সময়ে বিএনপিকে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, গুম, গ্রেফতার ও জেল এবং নানা মিথ্যা মামলার পরও বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
এখনো টিকে আছে মূলধারার দ্বি-দলীয় রাজনীতির অঙ্গনে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। যার মূলে রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের দক্ষতা এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশের মানসিক দৃঢ়তা ও ত্যাগের মনোবৃত্তি। তবে এ কথাও সত্য যে, ৩৯ বছরে পা দেওয়া বিএনপির টিকে থাকার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক শক্তির চেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তাই মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। অবশ্যই এর মূলে রয়েছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং সেই সাথে বাংলাদেশের জনগণের বড় অংশের আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী মানসিকতা।
এ কথাও সত্য যে, ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপি এখন পর্যন্ত সরকারবিরোধী সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকায়। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তারা দেশব্যাপী আন্দোলন তীব্র করে সরকারকে কোণঠাসা করলেও রাজধানী ঢাকার সুবিধাবাদী ও সম্পদ রক্ষায় সচেষ্ট এবং সরকারের সাথে গোপনে আপস করা নেতাদের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। মাতৃসংগঠনের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠন। বিএনপির এই তিন সংগঠন এখনো দুর্বল।
সাংগঠনিক এবং আদর্শিক দুর্বলতা বজায় থাকলে বিএনপির পক্ষে কখনো রাজপথের শক্তিশালী সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়া এবং সে আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এরই সূত্র ধরে এ প্রশ্নও এসে যায় যে, আজকের বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশ জিয়াউর রহমানের আদর্শ কতটা ধারণ ও লালন করেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশের মধ্যে রাজনীতি চর্চা এবং রাজনীতি বিষয়ে অধ্যয়ন নেই বললেই চলে। দেশি-বিদেশি অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখতে বিএনপির কত শতাংশ নেতা-কর্মী সচেতন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়কের ভূমিকা পালন করছে সে সম্পর্কে বিএনপির নেতা-কর্মীদের কতটা উপলব্ধি বোধ রয়েছে জানা নেই।
আদর্শিক সংকটের কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে পড়েছে সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী। দলের জন্য কাজ করার চেয়ে এরা পদ-পদবিকেই বড় করে দেখেন। কাক্সিক্ষত পদ না পেয়ে দল থেকে পদত্যাগ এবং দলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দলকে সংকটের মুখে ঠেলে দেন। তবে এ কথাও সত্য যে যোগ্য, ত্যাগী এবং নিবেদিত প্রাণ নেতাদের মর্যাদা দান না করা এবং তাদেরকে কাক্সিক্ষত পদ থেকে বঞ্চিত করে অযোগ্য অনভিজ্ঞদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো এবং সকল স্তরের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বড় ধরনের ব্যর্থতা। আরেকটি বিষয়ও আলোচনার দাবি রাখে আর তা হলো, জনপ্রিয় দল হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান বিএনপি জনগণের প্রত্যাশা ও আশা-আকাক্সক্ষার কাছে খুব কমই থেকেছে।
সীমাহীন লুটপাট, অর্থ কেলেংকারি, গণনিপীড়ন এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকা- ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্ব জনগণকে সাথে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়তে পারেনি। ভারতকে নামমাত্র মূল্যে ট্রানজিট ও করিডোর প্রদান এবং রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্ব অনেক দেরিতে হলেও মুখ খুলেছেন। একে বিএনপির এক ধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাই বলতে হবে। মনে হয়, ভারত নাখোশ হবে এই ভয়ে দীর্ঘদিন বিএনপি নেতৃত্ব জাতির অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নীরব থেকেছে। বিএনপি হয়তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করেছিল। কিন্তু মোদি সরকার হাসিনা শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার কারণে আশাহত বিএনপি নেতৃত্বের মুখ দিয়ে ইদানীং কিছু কিছু কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরি জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ৪০ মিনিটের বৈঠককে বিএনপি তার জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখতে পারে। এর মধ্যে দিয়ে এটিই প্রমাণিত হলো, বিএনপিই যে প্রকৃত সরকারবিরোধী দল এ সত্য বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিল। নিঃসন্দেহে এ ঘটনা শেখ হাসিনার সরকারকে যথেষ্ট বিব্রত ও নার্ভাস করেছে। বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগের মতো নতুন করে স্বপ্ন জাল বুনতে শুরু করেছেন যে, হিলারি ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। এ স্বপ্ন কতটা পূরণ হবে তা নিশ্চিত নয়।
জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে নয়, শক্তিধর বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর আশীর্বাদ ও সহায়তা নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্ন বিএনপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার আরেকটি দিক ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে। সুতরাং ৩৯ বছরে পদার্পণ করে বিএনপি নেতৃত্বকে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। গ্রহণ করতে হবে বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত। বিদেশি শক্তি নয়, জনগণের শক্তির ওপর ভর করতে হবে। গণদাবি ও স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে হবে। তার আগে বিএনপিকে পরিশুদ্ধ হতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও সুযোগসন্ধানীদের নেতৃত্ব-পদে বহাল রেখে আন্দোলনের ডাক দিলে তাতে জনগণ সারা দেবে না। তাই নিজেকে পরিবর্তন করে বিএনপি নেতৃত্বকে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করে জনগণকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন শুরু করতে হবে। শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়া সম্ভব হলে সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন