সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে সবচাইতে বড় ঘটনা ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেতাদের মধ্যে সফর বিনিময়, দেখা সাক্ষাৎ ও আলোচনা সাধারণত স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই বিবেচিত হয়। কারণ, এর মধ্যে দিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সৎ প্রতিবেশীসূলভ সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।
এ সম্পর্কে আলোচনা শুরুর আগে যার সফর নিয়ে এ লেখা, তার বিশেষ পরিচয় তুলে ধরলে পাঠক-পাঠিকাদের পক্ষে এ সফরের স্বরূপ উপলব্ধি করা সহজ হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি এক সময় ভারতের অন্যতম রাজ্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা বাঁধে। এই দাঙ্গায় বহু নিরিহ মুসলমান প্রাণ হারান। এই দাঙ্গায় শাসক দল হিসাবে বিজেপি সংখ্যালঘু মুসলমানদের রক্ষার পরিবর্তে দাঙ্গাকারী সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সমর্থন দেয়। পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দ্বিতীয় মেয়াদে সমাসীন রয়েছেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রচারণাকালে তাঁর দল বিজেপির কর্মীসমর্থকরা এই বলে তার সপক্ষে জনগণের ভোট প্রার্থনা করেন যে, ভারতে মুসলমানদের দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করতে হলে নরেন্দ্র মোদিকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী করা অত্যাবশ্যক।
এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দান করেন, তা তিনি বিশ্বস্তভাবে পালন করেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর প্রথম সুযোগেই দেশের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্য কাশ্মীরকে এমনভাবে বিভক্ত করেন, যাতে কাশ্মীরের মুসলমানদের প্রাধান্য দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতীয় সংবিধানের যে ধারা বলে কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত, সে ধারাও বাতিল করেন তিনি। তাছাড়া যেখানে সেনাবাহিনীর শাসন প্রতিষ্ঠাও করেছেন। সেখানে সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে নেন্দ্রীয় শাসন পাকাপোক্ত করেন। এছাড়া আসামে নাগরিক আইন কার্যকর করে মুসলমানদের আসামছাড়া করার ব্যবস্থা করেন। এসব কারণে নরেন্দ্র মোদির আগমনকে বাংলাদেশের জনগণ ভালো চোখে দেখেননি। যেদিন নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন, সেদিন অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতসহ বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এইসব বিক্ষোভের বিরুদ্ধে সরকার পুলিশি কার্যক্রম চালায়। পুলিশের পাশাপাশি এতে বহিরাগতরাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ফলে নরেন্দ্র মোদির সফর উপলক্ষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অশান্তি ও বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কে বা কারা দায়ী- সে প্রশ্নে নিরপেক্ষ আলোচনা করতে গিয়ে সফরকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ছাড়া আর কাউকে আমরা দায়ী করতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ যে নরেন্দ্র মোদির সফরে আসাকে পছন্দ করছে না, সেটা কারো অজানা থাকর কথা নয়। এ বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন নেতা ব্যর্থ হবেন, এটা হতেই পারে না। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের জনগণকে ইচ্ছা করেই যে তিনি বিপাকে ফেলেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি বাংলাদেশকে মুখে মিত্র দেশ বললেও এ বক্তব্য যে তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন না, তার বহু প্রমাণ রয়েছে। এখানে এর একটি মাত্র প্রমাণ দেব। দুই বন্ধুদেশের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে যদি সংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে যেসব ইস্যুতে বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয় সেসব ইস্যুতে সমঝোতা সৃষ্টির আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব ইস্যুতে বিরোধ চলছে তার মধ্যে রয়েছে দুই দেশের মধ্যে দিয়ে যেসব অভিন্ন নদী প্রবাহিত রয়েছে, তার পানি বণ্টন সমস্যা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার (বাংলাদেশে পদ্মা) পানি নিয়ে ফারাক্কা চুক্তি সম্ভব হয়েছিল যদিও, কিন্তু সে চুক্তির সবকিছু বাস্তবে মান্য করা হচ্ছে না। ভারতের অনিচ্ছা ও অনীহার কারণে চুক্তির অনেক কিছু বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবুও চুক্তি একটা যে হয়েছিল, তা অস্বীকার করছে না ভারত, এটা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু এবার আমরা কী দেখলাম? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রশ্ন করলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে কোনো কথাই বললেন না। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে তিনি প্রমাণ দিলেন যে, শেখ হাসিনার এ প্রশ্নের কোনো গুরুত্বই নেই তার কাছে। এটা শুধু শেখ হাসিনাই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জন্যই অপমানজনক।
এত কিছুর পরও আমরা ভারতের সাথে সৎ প্রতিবেশীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু কোনো দু’টি দেশের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে যদি সংশ্লিষ্ট দুই দেশের নেতাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সপক্ষে আন্তরিক মনোভাব সৃষ্টি হয়। নইলে এক পক্ষ হাজার আন্তরিক হলেও অন্য পক্ষ যদি আন্তরিক না হয় তাহলে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে না। আমরা মনে করি, নরেন্দ্র মোদি সেই কাক্সিক্ষত আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে পারেননি। তিনি শুধু কানেকটিভিটির কথা বলেছেন বারবার। কিন্তু এই কানেকটিভিটি আন্তরিক বন্ধুত্বভিত্তিক না হলে হয় না। তা তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কানেকটিভিটির অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারত যেহেতু পাশপাশি অবস্থিত দেশ, কাজেই বাংলাদেশ ভারতের মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
এখানে আমরা একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্তের বিষয় উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশ তখন সবেমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। লাহোরে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশও সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হলো। কিন্তু ভারত ছিল এই সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের ঘোরতর বিরোধী। এ অবস্থায় মহা সমস্যায় পড়লেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অগত্যা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে তার পরামর্শ কামনা করলেন। মওলানা ভাসানী সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি যদি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাকো তাহলে তোমার মনের যা ইচ্ছা সেমতেই কর্ম করো। আর যদি তুমি স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতা না হয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অনুগ্রহভাজন নেতা হয়ে থাকো তাহলে সে রাষ্ট্র যা বলে তাই করো। একথার মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর কাক্সিক্ষত জবাব পেয়ে গেলেন। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, তিনি লাহোর সম্মেলনে যোগ দেবেন।
যেদিন তিনি লাহোর গেলেন। সেদিন ভারতে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। বঙ্গবন্ধুর এই দৃষ্টান্ত স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোনো যুগের, যে কোনো নেতার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। অন্যপক্ষে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিয়েছে, এই অন্ধ বিশ্বাসে কেউ যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা প্রশ্নে ভারতের মতামতকে অন্ধভাবে অনুসরণীয় বিবেচনা করে তাহলে তা হবে প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী এবং বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তাকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করলে বা বিকিয়ে দিলে তা হবে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন