শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নরেন্দ্র মোদির অসত্য বক্তব্য

মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ, ২০২১ খ্রি. ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দু’দিনের সফরে ঢাকা আসেন। ঢাকা অবস্থানকালে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ‘সত্যাগ্রহ’ করেন এবং এই সত্যাগ্রহ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। তাঁর এই কথা বড় ধরনের অসত্য। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, একজন প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন অসত্য বিবৃতি দেয়া দেশের পক্ষে অপমানজনক। ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অসত্য বিবৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন এবং উপদেশ দিয়ে বলেছেন ‘দোহাই আপনার, দেশের বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, নবীন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস বিকৃত করবেন না’।

ড. মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদির সাথে আমার ব্যক্তিগত বা পুরাপুরি নীতিগত সম্পর্ক নেই। কিন্তু অবস্থানগত কারণে আমাদের নিজের চিন্তা ও মত একি মলাটে, একি পুস্তকে ভিন্ন ভিন্নভাবে লিখিতভাবে প্রকাশিত হয়েছিল- ২০০৬ ও ২০০৭ সালে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এর সুভ্যিনারে। তখন ড. মনমোহন সিং ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। আমি ছিলাম ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলের নির্বাহী পরিষদ সদস্য, মাননীয় বিচারপতি জি.এন.রায় ছিলেন প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র চেয়ারম্যান।

প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র ২০০৬ ও ২০০৭ দু’টি সুভ্যিনারে একইভাবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিডিয়াকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, মিডিয়াকে অবশ্যই মৌমাছির মতো হতে হবে- মাছির মতো নয়। তিনি তাঁর লেখায় বলেছিলেন, মৌমাছি ফুল থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে মধু দেয় আর মাছি ময়লা-আবর্জনায় বসে রোগ ও দুর্গন্ধ ছড়ায়। তাই মিডিয়াকে মৌমাছির মতো হতে হবে- মাছির মতো নয়। ঐ সুভ্যিনারে লেখায় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বলেছিলেন, মিডিয়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাস বসু, গোখলে প্রমুখ সাহসী নেতা ও ব্যক্তিরা দেশের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিলেন। ২০০৬ সালে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র সুভ্যিনারে ‘প্রেস ফ্রীডম: এ কন্টিনিউয়িং স্ট্রাগেল’ (পৃষ্ঠা-১৪৫-১৪৬) এবং ২০০৭ সালের সুভ্যিনারে ‘ফ্রীডম অব দ্যা প্রেস ইজ এ ফান্ডামেন্টাল রাইট’ (পৃষ্ঠা-৬৯-৭৩) শিরোনামে আমার দু’টি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। ২০০৬ সালের সুভ্যিনারে প্রেসিডেন্ট ড. এপিজে আব্দুল কালাম ও ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট প্রতিভা দেবি সিং পাতিলের লেখাও ছাপানো হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় মধু চেয়েছেন। এখন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়ে অসত্য বিবৃতি দিয়ে দুর্গন্ধ ছড়ালেন। নিজেকে নিজেই হাস্যস্পদ ও হেয় করলেন। তর্কে না নিয়ে সহজ-সরলভাবেই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের জনগণ ও রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। ভারত শরণার্থীদের আশ্রয়-খাবার দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-অস্ত্র দিয়েছিল। ভারতের সরকার ও জনগণ কেউ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধী ছিল না। ইন্দিরা সরকারের আমলে বাংলাদেশের পক্ষে সত্যাগ্রহ করার কথা অলীক। সেখানে কেউ সত্যাগ্রহ করে থাকলে তা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ করে জেল খেটে থাকতে পারে।

আমাদের কথা হচ্ছে, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে তাদের দেশ থেকে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের সন্তানরা, দেশবাসী রসদ-আশ্রয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। অনেকে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে দেশে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছেন। সার্বিকভাবে সকলের অবদানে, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা এসেছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। মাত্র কিছু সংখ্যক বিপদগামী ছাড়া সবাই স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক শাসন, শোষণহীন সমাজ, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধান। আমরা কি আদৌ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছি? গণতন্ত্রের অর্থই হলো জনগণের শাসন। এটা আছে কি? মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা জাতীয় নিরাপত্তার পূর্বশর্ত। এই পূর্বশর্ত আমরা পূরণ করতে পারছি কি? সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের মর্যাদা রক্ষার পূর্বশর্তের জন্যই ভারতে আইনের প্রতি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আনুগত্যের ট্রেডিশন এখনো চলছে।

একজন সাবেক বিচারপতি তিনদশক আগে বলেছিলেন, ‘নির্বাচিত সব ব্যক্তি যোগ্য নয়- অযোগ্য ব্যক্তিও অনেক সময় নির্বাচিত হয় বড় পদে’। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সত্যাগ্রহ’ নিয়ে দেয়া মন্তব্য তাঁর যোগ্যতা নিয়ে ঐ বিচারপতির বলা কথাটিই মনে পড়ে যায়।

আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমগ্র জাতির শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে একটি পথভ্রষ্ট, স্বার্থান্বেষী, লক্ষ্যভ্রষ্ট, নীতিজ্ঞান শূন্য মহল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রতারণা, জুলুম ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সুবিধা-সুযোগ নেয়া বড় নয়, সম্মান ও ভালবাসাই বড়। মুক্তিযোদ্ধার সাথে প্রতারণার একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। বিষয় হলো: এবার ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন। এই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্যানেল থেকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হয় অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেমকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা (কক্সবাজারসহ) ছাত্রলীগের সভাপতি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রধান নেতা ছিলেন।

চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিবাহিনী (এফ এফ) কমান্ডার ছিলেন। আমারও কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক দেশ বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। উনি যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনেও ছিলেন। হাশেম ভাইয়ের প্যানেলের অন্যান্য পদের প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। তাঁর সাথে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। তা না হলে তাঁর প্যানেলের অন্যান্যরা নির্বাচিত হলেও তিনি কেনো নির্বাচিত হলেন না? হাশেম ভাইয়ের বয়সে অনেক অনেক ছোট ও জুনিয়ররা ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাশেম ভাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে নির্বাচিত হতে দেয়া হয়নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাই ত্যাগ স্বীকার করে, রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা এখনো জীবিত আছেন তাঁদের সকলকে অত্যাচার, অবিচার, জুলুম ও অসত্যের বিরুদ্ধে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বত জীবনী শক্তি সব লোভ-প্রলোভনের মাথায় পদাঘাত করে ঐক্যবদ্ধ থাকবে- এই প্রত্যাশাই করি। ইতিহাস শিক্ষনীয় হয়, হস্তক্ষেপের বিষয় নয়।

ইতিহাসে হস্তক্ষেপ ও ইতিহাস বিকৃতি খেয়ানতের শামিল। ইতিহাসের আমানত যাতে খেয়ানত না হয় সেদিকে সকলকে লক্ষ রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক-মুক্তিযোদ্ধা, ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলস্ নির্বাহী পরিষদ ও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, ইজতিহাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন