জীবন থেমে থাকে না। চলতে থাকে। কখনো ভালোভাবে ও কখনো খারাপভাবে। রাজনীতিতেও ভালো-মন্দ আছে। রাজনীতিবিদরা কখনো থাকে রাজপ্রসাদে, কখনো-বা জেলে। তবে অপকর্মের জন্য সাজা ইদানিং বেশ বেড়ে গিয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানব পাচার ও অর্থ পাচারের মামলায় ল²ীপুরের সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলকে কুয়েতের এক আদালত চার বছরের কারাদন্ড দিয়েছে। এইটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম ঘটনা যে, কোনো সংসদ সদস্য বিদেশের আদালতে সাজা পেলেন। দেশের সম্মান, মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। মানুষ খুবই মর্মাহত। সংসদ সদস্যদের নিকট থেকে জাতি এ রকম উদাহরণ কখনো আশা করে না।
একইদিনে টিআই অর্থাৎ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছে। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়ে ১৪৬তম স্থানে অবস্থান করছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২০ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১২তম। ২০২০ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আমাদের সমানে মিডিয়ার মাধ্যমে এসেছে। দুর্নীতি পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে টানা তিন বছর বাংলাদেশের স্কোর হচ্ছে ২৬। অর্থাৎ তিন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নেই।
টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এ সম্পর্কে নানা বক্তব্য তুলে ধরেছেন। দুর্নীতিরোধে দেশের কী করণীয় তা-ও তারা উল্লেখ করেছেন। টিআইবি’র মতে, বাংলাদেশের দুর্নীতির লাগামকে শক্ত হাতে টেনে ধরতে হলে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা রাজনৈতিক দলসমূহের থাকতে হবে। ২. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে আরও বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। ৪. সচেতন নাগরিক সমাজকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও বেশি বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। ৫। দেশে দুর্নীতিবিরোধী এক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
টিআই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক স্কোর অপরিবর্তিত। এটি অতন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। দেশে ক্ষেত্রবিশেষ দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোরতম প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি সমানতালে কার্যকর হচ্ছে না। কারণ, যারা দুর্নীতির রশিকে টেনে ধরবেন, তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে সহযোগিতা করছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ঘোষণাই থেকে যাচ্ছে। সমাজে দুর্নীতির সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত শক্তিশালী। রাজনৈতিকভাবে তাদের শিকড় বহু গভীরে। তাই সমাজে সর্বত্র দুর্নীতি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে বাংলাদেশ। সে কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের জন্য স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকার বাধ্য। কিন্তু দেশে দুর্নীতি পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান যেরূপ, সেই অনুযায়ী প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক এই সকল তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক, শাস্তিমূলক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বড় সমস্যা। স্বাধীনভাবে আর্থিক খাত কাজ করার সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত। তাই দুর্নীতি নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, যে সংস্থাটি দুর্নীতি দমনে দায়িত্বশীল, সেই দুর্নীতি দমন কমিশন অতিব দুর্বল। রাজনৈতিক আনুগত্যে ভরপুর। কর্মকর্তাদের মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতাও যেন নাই বলা যায়। আবার মনে হয়, যেন কারো নির্দেশের অপেক্ষায় সবসময় দুদক সময় ক্ষেপণ করে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষ দিন দিন বিরক্ত হচ্ছে। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমও যেন দিন দিন দুর্নীতির ব্যাপারে খেই হারিয়ে ফেলছে। গা সহা হয়ে পড়ছে। এই লক্ষণ খুবই খারাপ। মানুষের কণ্ঠস্বর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বড়ই প্রয়োজন। ডিজিটাল আইনে বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তা সংশোধন হওয়া জরুরি।
সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন যেন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তাতে দুর্নীতি বৃদ্ধিতে সহযোগিতা হচ্ছে। দেশের সকল ট্রেড বডি এখন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতের মুঠোয়। তাই ব্যবসার স্বার্থে কথা বলার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে পড়েছ। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাই এই সকল ক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি উৎসাহিত হচ্ছে।
দুর্নীতি হ্রাসের উপায় কী? বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি আছে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এত ব্যাপক হারে নয়। দুর্নীতি নিরোধে নরওয়ে ও সুইজারল্যাÐ বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। কেমন করে এই দু’দেশে দুর্নীতি নাই বা কম হচ্ছেÑ তা আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। এমন কি ভুটান ও পাকিস্তান আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে। তারা পারলে আমরা কেন পারবো না? পারবো। তবে কিছু কঠোর, কঠিন, স্বচ্ছ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেমন:
১। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, হ্রাস বা বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান সরকার। সরকারকে এইজন্য কঠিন ও কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সরকার প্রধান বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কান দিচ্ছি না। আমাদের কান দিতে হবে। সকলকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘না’ বলতে হবে। যেমন মাদককে ‘না’ বলতে হবে, তেমনি দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে হবে একযোগে, এক সাথে। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘না’ সূচক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে দুর্নীতি মুক্ত থাকার ঘোষণা দিতে হবে।
২। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি মজবুত, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। দেশের সকল পর্যায়ে নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার ভূমিকা রাখতে হবে। জবাবদিহিমূলক নির্বাচন না করতে পারলে নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে জবাবদিহিতা আসবে না। জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা, ভয় ও জবাবদিহি না থাকলে কখনো দুর্নীতি হ্রাস পাবে না।
৪। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ, সৎ ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশাসনকে সবসময় নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। প্রশাসন জনগণের জন্য, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়- তা মনে করতে হবে। তবেই দুর্নীতি দমনে প্রশাসনের ভূমিকা দৃশ্যমান হবে।
৫। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে মানুষের জন্য আরও বেশি কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের দক্ষতা, সততা, নিরপেক্ষতার উপর সকল পর্যায়ে দুর্নীতি হ্রাসে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিজ নিজ দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করার জন্য সরকারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সত্যিকার অর্থে নিশ্চয়তা দিতে হবে। শুধু মুখে বলা নয়, বাস্তবে নিশ্চয়তা দেয়ার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি হ্রাস করে উন্নয়নের সূচককে আমরা এগিয়ে নিতে পারি।
লেখক: প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি., অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন