মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
আসছে ঈদুল আজহা। সারাদেশে ঈদের আমেজ বইছে। ঠিক এমন সময় জেলায় জেলায় চলছে বন্যা, কানে বাজছে মুহুড় মুহুড় গুলির শব্দ। জঙ্গি আর জঙ্গিবাদের সংবাদের সংবাদে চাপা পড়ছে সাধারণ মানুষের আহাজারি। উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেকগুলো জেলায় গত তিন মাস ধরে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। পেটের ক্ষুধা আর পারিবারিক সমস্যা তাড়া করে বেড়াচ্ছে বানভাসি মানুষদের। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি। ‘ধরলা-তিস্তার ৬৩ চরের মানুষের কাছে ঈদের ঈদ শুধুই স্বপ্ন’; ‘যশোরের কেশবপুরের এখনো পানিবন্দি’ এমন সংবাদ সত্যিই বেদনাদায়ক। বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ীসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু জেলার মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও নদ-নদীর পানি সামান্য কমে গেলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। অনেকের বাড়িঘর এখনো পানির নিচে। কোমর পানি নিয়ে চলতে ফিরতে হয়। পশু ও মুরগির খামার ভেসে গেছে পানির তোড়ে। মাছের পুকুরগুলো পরিণত হয়েছে বিশাল জলাশয়ে। একটু বিশুদ্ধ পানি পেলে কয়েকজনে ভাগাভাগি করে পান করছেন। খাবারের অভাবে হাজারো মানুষ কান্না করছে। বাড়ির ছাদ ও টিনের চালায় বসবাস করছে বানভাসি মানুষ।
এখানেই শেষ নয়। ইতোমধ্যে কয়েকশ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতল বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বন্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা যাচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময়ে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া যাবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে পানির নিচে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা স্বপ্নের বাড়িঘর ভেঙে নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাওয়ায় অনেকেই দিশেহারা। ঘর তুলবার মতো সামর্থ্য নেই অনেকেরই। নতুন করে ঘর তোলার কাজ এক ধরনের যুদ্ধ। রুজি-রোজগারের উপায় খুঁজে বেড়ালেও চাহিদানুযায়ী কোন ব্যবস্থা হয় না। খাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির সংকট ছাড়াও গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষের চেয়ে গবাদিপশু বেশি কষ্টে দিন পার করছে। মানুষের খাদ্য হিসেবে শুকনা ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হলেও গো খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেকেই খাবার কষ্টে ভুগছেন। এরইমধ্যে চাল আর লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেয়ালে পিঠ লেগে গেছে। একই সাথে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে ভুগছেন অনেকে। পেটে পীড়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, ঠা-াজনিত রোগ ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। জেলে, কৃষক, দিনমজুর শ্রেণির মানুষগুলোই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছেন। পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা বিপদের মুহূর্তে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছে না। মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কোথায় থাকবেন কী করবেন, কী খাবেন তা জানা নেই। এভাবেই চলছে মানুষের জীবন।
বন্যার্ত এলাকার মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। সরকারি, বেসরকারিভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার যাদের পাওয়ার কথা তারা অনেক সময়ই বঞ্চিত হন। আর যাদের আর্থিক অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভালো তাদের অনেকেই লোভ সামলাতে পারেন না। বন্যাপীড়িত বহু এলাকা এমনও রয়েছে যেখানে সাহায্য পৌঁছেনি। সরকারের তরফ থেকে যৎসামন্য, খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে সেটিও নিজ দলের কর্মীর মধ্যে ভাগভাটোয়ার হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বন্যার্ত মানুষের মধ্যে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি উঁচু করে দেয়ার যে ৪০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সংশয় থাকার একটি বড় কারণ হলো- দুর্নীতি ও দলীয়করণ। প্রাসঙ্গিক কারণে বলতে হয়। আমার নিজ জেলা পটুয়াখালি। ২০০৭ সালে সিডর পরবর্তী সময় দেখা গেছে, আমাদের এলাকায় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম ছাড়াও যেসব দেশি-বিদেশি সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন তাদের দেশীয় কর্মচারীরা অর্থের বিনিময়ে নাম তালিকাভুক্ত করেন। এতে করে যার ত্রাণ পাওয়ার কথা ছিল সে পায়নি। আর যাদের ত্রাণ নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না সেই ব্যক্তি একটি টিনশেড ঘর পাওয়ার আশায় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে একটি পাকা ঘরের জন্য হন্য হয়ে ছুটেছিলেন। এলাকায় যে লোকটি সবচেয়ে গরিব সে ওইভাবে টাকাও দিতে পারে না বলে সে আর থাকার জন্য সামান্য ঘরটুকুও পায় না। এবারেও প্রকৃত দরিদ্ররা ত্রাণ পাবেন কিনা তা সঠিক করে বলা যায় না। টিআর ও কাবিখার বরাদ্দের বেশির ভাগ নেতাদের পকেটেই যায়। দেশে অনেকগুলো সামাজিক সংগঠন রয়েছে, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সেøাগানে রাতে ঘুমানো যায় না। অথচ বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ কেজি করে ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও তাদের অধিকাংশই সে চাল পাননি এমন সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে সংশয় আরো ঘনিভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে পানি প্রবেশের মূলপথ তিনটি, অথচ নির্গমনের পথ মাত্র একটি। যখনই পানির প্রবাহ নদীসমূহের ধারণ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে, তখনই বন্যা সংঘটিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। অপরদিকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ আমাদের অন্যান্য নদী দ্বারা প্রবাহিত পানির শতকরা ৯০ ভাগই বাইরে থেকে আগত। ফলে বন্যা বা যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তা থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় লাগে। তবে এ মুহূর্তে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
‘মানুষ মানুষের জন্য’Ñকথাটি আজ গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আপনি যখন এ লেখাটি পড়ছেন কিংবা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যাচ্ছেন ঠিক সে সময়ে পাশের আরেকজন মানুষের বুক ফেটে কান্না আসছে। তার পেটে ভাত নেই, কাপড় নেই, মুখে খাবার নেই। রোগে-শোকে ভুগছেন। একবার হলেও একটু চিন্তা করুন, অভাবী মানুষগুলোর জন্য আপনার কি কিছুই করার ছিল না? বিলাসিতা, আরাম-আয়েশকে ত্যাগ করে বানভাসি সহায়সম্পদহীন, রোগে-শোকে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো খুবই দরকার। দলমত নির্বিশেষে বানভাসি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। দানের হাতকে প্রসারিত করুন। শুধু তাদের পাশে গিয়ে ছবি তুলে বাহবা নেয়ার চেষ্টা না করে মানবতার সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এক মহান সওয়াবের কাজ। অন্যকে সাহায্য করলে নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহ অবশ্যই তাদের উত্তম প্রতিদান দিবেন। আপনার অর্থকড়ি সামান্য হলেও সাহায্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। কেবল সরকার আর ধনীদের থলের দিকে না তাকিয়ে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন। আপনার দেখাদেখি অন্যরাও আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে, অবশ্যই আপনার হাতকে শক্তিশালী করবে। হতে পারে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিটি আপনার উৎসাহ দেখে দানের হাতকে প্রসারিত করবেন। তাই আসুন, আপনি এবং আমি নিজেরাই শুরু করি; যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী। তাহলে হয়তো বানভাসি কিছু সংখ্যক মানুষের মুখেও হাসি ফোটাতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আর কুরবানির শিক্ষা তো এটাই।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন