শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে

প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
আত্মবিশ্বাসের সাথে বেঁচে থাকার নামই জীবন। জীবনে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ও ভয়াবহ দুর্যোগ আসতেই পারে; তারও একটা সমাধান কোথাও না কোথাও আছে। আত্মহত্যা কখনোই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। প্রতিটি আত্মহত্যাই একটি ট্র্যাজেডি। হতাশা, অভিমান, ব্যর্থতা, কুসংস্কার, অপমান, ঝগড়া, দাম্পত্যকলহসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সহপাঠী, বন্ধু, পরিবার ও সমাজ। সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বিষণœতা, মানসিক হতাশা, বখাটেদের উৎপাত, ভালবাসায় ব্যর্থতা, প্রতারণা, ক্ষোভ প্রভৃতি থেকে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-স্বজনদের সহমর্মিতা, কাউন্সেলিং, হাসপাতাল ও বাসায় রেখে চিকিৎসা কার্যকর সুফল দিতে পারে বলে মনে করেন মনোবিদ-বিশেষজ্ঞরা।
আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজেই ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা ও কষ্ট দেয়া। ইসলামি দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা ঘৃন্যতম মহাপাপ। আল্লাহপাক মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে, নিজেই নিজেকে হত্যা করে ফেলে। আল্লাহতাআলা বলেন, ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে’। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র আল্লাহর। অতএব, কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করলেন, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না।
আত্মহত্যা তো দূরের কথা কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনাও নিষেধ। দুনিয়ার সামান্য কষ্ট যে সইতে পারবে না, সে আখেরাতের মহাকষ্ট কি করে সইবে? রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, হে আল্লাহ আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়’। জীবনযাপনের দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা জেদের বশবর্তী হয়ে অনেকে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। কিন্তু ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর ওপর ভরসা ও দৃঢ় আস্থা রাখলে কারও আত্মহত্যার মতো ক্লেশকর পথে পা বাড়াতে হয় না। আত্মহত্যার পরিণামে কঠোর শাস্তির বর্ণনা দিয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গোটা বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে ছিল প্রায় সাড়ে ৬৫ লাখ মানুষ। এখানে প্রতি বছর গড়ে আত্মহনন করে ১০,৪৮৪ জন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন। বিশ্বে আত্মহত্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বিষণœতায় ভুগছেন ৩৬০ মিলিয়নের মতো। বাংলাদেশেও এ সংখ্যা কম নয়।
বর্তমান সময়ে দিনের পর দিন বেকারাত্ব যুব সম্প্রদায়ের মানসিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ। বেকারত্ব শুধু মানসিক অসুস্থতাই নয়, কারণ হয়ে উঠছে অবসাদসহ শারীরিক অসুস্থতারও। বেকারত্ব, আর্থিক অসচ্ছলতার চাপ ও ধকল অনেক সময়ই মন সামলে উঠতে পারে না। আর্থ-সামাজিক অবস্থান, পরিবারের অসহযোগিতা, অবহেলা, অকারণে দোষারোপ, মানসিক অবসাদগ্রস্তদের আরও বেশি আত্মহত্যা প্রবণ করে তুলছে। শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই বাইপোলার ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক অবসাদজনিত কারণে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে যুবসমাজ। যে তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পথে এগিয়ে যেতে হবে, অথচ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক।
আত্মহত্যার পেছনে থাকে প্রচ- মনস্তাত্ত্বিক চাপ। ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহননের মধ্য দিয়ে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা মুক্তি খোঁজে। আত্মহত্যার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করে, সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। আর যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেট ফুঁড়তে থাকবে’। ‘কোনো ব্যক্তি যেই জিনিস দ্বারা আত্মহত্যা করবে, কেয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস দ্বারাই শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে, সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে, সে দোজখেও সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে’।
আত্মহত্যা থেকে বাঁচার উপায় : সাহসীরা নানা প্রতিকূলতায়ও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর উপর ভরসা করে সমস্যার সাথে লড়াই করে থাকে। নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হলে আত্মহত্যার কুচিন্তা মনে আসে। তখন মনে করতে হবে, এসব কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানেরই দুরভিসন্ধি। তাই এসব মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে অবশ্যই দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। কখনো আত্মহত্যার কথা মনে এলে ফেতনা থেকে নিজকে রক্ষাকল্পে নামাজের মাধ্যমে বিনীতভাবে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য কামনা করা উচিত। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’ (বাকারা)।
মুসলিম পরিবার ও সমাজ জীবনে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে সর্বস্তরের নর-নারী ও সন্তান সন্ততির বেঁচে থাকার জন্য ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা। মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলীর অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। মূলত ধৈর্যের অভাবেই মানুষের মাঝে এমন একটি মহাপাপের বিস্তার ঘটছে। এছাড়া শয়তানের কু-প্ররোচনা তো আছেই। সব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে ইসলামের আইন ও অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল এই মহাব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সফলতার সুসংবাদ। কারণ, আল্লাহপাক ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর মেহেরবান আল্লাহ যার সঙ্গে থাকবেন তার সফলতা অবধারিত। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদিগকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (বাকারা)। রাসূল (সা.) বিপদ, দুশ্চিন্তা এবং হতাশা থেকে পরিত্রাণের জন্য জন্যে নিম্নলিখিত দোয়াগুলো পড়তেন।
১. ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইল্লাইহি রাজিউন, আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলুফ লাহু খাইরান মিনহা’। অর্থাৎ, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, বিপদে আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর থেকে উত্তম বিকল্প দান কর। যে ব্যক্তি বিপদে, মুসিবতে এই দোয়া পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার বিপদ দূর করবেন এবং তার যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন (বুখারি, মুসলিম)।
২. ‘লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্্-জালেমিন’। অর্থাৎ, আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। অবশ্যই আমি পাপী। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি উক্ত দোয়া পাঠ করবে, সে যে সমস্যায়ই থাকুক আল্লাহতায়ালা তার ডাকে সাড়া দেবেন। এছাড়াও কোনো চিন্তিত, দুঃখিত, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিদিন এ দোয়া পাঠ করলে আল্লাহতায়ালা তার ডাকে সাড়া দেবেন।
৩. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হুল্ আজিমুল্ হালিমু, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল্ আরশিল্ আজিম, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস্ সামাওয়াতি ওয়া রাব্বুল্ আরদি ওয়া রাব্বুল্ আরশিল্ কারিম’ (বুখারি)। অর্থাৎ, আল্লাহ্ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি সুমহান মহাসহিষ্ণু। আল্লাহ্ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি আকাশ ও যমিনের পালনকর্তা এবং সুমহান আরশের অধিপতি।
৪. ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আঊজুবিকা মিনাল্ হাম্মি ওয়াল্ হুজনি ওয়া আঊজুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল্ বুখ্লি ওয়া আঊজুবিকা মিন গালাবাতিদ্ দায়নি ওয়া কাহরির রিজাল’ (বুখারি)। অর্থাৎ, হে আল্লাহ্ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও কাপুরুষতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষের অত্যাচার থেকে।
৫. ‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুম বিরাহমাতিকা আস্তাগিছ, ফা আসলেহ্ লি শা’নি, ওয়ালা তাকেলনি ইলা নাফসি ত্বারফাতা আইন্’ (নাসাঈ)। অর্থাৎ, হে মহান ও সকল কিছুর মালিক। আপনার কাছে আমি সাহায্য প্রর্থনা করছি, সুতরাং আমার সকল অবস্থা সংশোধন করে দিন এবং এক পলকের জন্য হলেও আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দিয়েন না।
আত্মহত্যার প্রতিফল সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম’ (বুখারি, মুসলিম)।
যে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা সত্ত্বেও মৃত্যুবরণ না করে, তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারণ সে আত্মহননের চেষ্টা করেছে যা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এহেন ব্যক্তির উচিত পরিপূর্ণ তওবা, ইস্তেগফারসহ মেহেরবান আল্লাহর সমীপে মাফ চাওয়া। যে কোন সমস্যায় হতাশ হয়ে পড়া কোন মুমিনের কাজ নয়। জীবনের নানা বাঁকে মুমিনের জীবনে হতাশ হবার মতো পরিস্থিতি প্রতি পদেপদেই আসতে পারে। দুঃখ-কষ্ট জীবনেরই অংশ। বিপদে হতাশ বা নিরাশ হওয়া আল্লাহর প্রতি ঈমানের বিপরীত।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন