পবিত্র রমজান মাস এবং করোনাকালীন লকডাউনের এই বিশেষ সময়ে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের আলেম-ওলামা পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতার-নির্যাতানের শিকার হচ্ছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিব জন্মশতবর্ষ উৎযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল হেফাজতে ইসলাম এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর আগেও একাধিকবার নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন, তখন কেউ বিরোধিতা করে মাঠে নামেনি। এবারের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ভারতে ক্রমবর্ধমান মুসলমান বিদ্বেষ, রক্তাক্ত দাঙ্গায় মুসলমান হত্যা এবং কোরআন পরিবর্তনের মামলাসহ নানাবিধ ইস্যুতে মোদিবিরোধী বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। খোদ ভারতেও বিভিন্ন স্থানে মোদিবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী জনমত অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের তৌহিদী জনতার প্রতিবাদে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও পুলিশের বাড়াবাড়ি ও অসহিষ্ণুতায় রক্তাক্ত ঘটনা না ঘটলে তা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হিসেবেই হয়তো পরিগণিত থাকতো। হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তবে দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর পরোক্ষ যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবাবিক নয়। হেফাজতে ইসলামের সাথে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সুসম্পর্কের কথা সুবিদিত। ২৬ মার্চ ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের কোনো কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও ছিল না। তথাপি চট্টগ্রামের হাটহাজারি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের আচরণে অসহিষ্ণুতা, অপেশাদারিত্ব ও সহিংসতা ফুটে উঠেছে। মোদিবিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশের হাতে দু’দিনে অন্তত ১৭ জন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক যে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে মত প্রকাশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার জনগণের রয়েছে। যে কোনো ইস্যুতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভের চর্চা উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও অহরহ ঘটে থাকে। তাই মোদিবিরোধী বিক্ষোভ দমনে পুলিশের এমন কঠোর ও অসহিষ্ণু ভূমিকা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। মোদিবিরোধী বিক্ষোভে নিহতদের প্রায় সবাই মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক অথবা সাধারণ মুসল্লি। এদেরকে গুলি করে হত্যা না করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া পুলিশের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। মূলত পুলিশের গুলিবর্ষণের কারণেই পরিস্থিতি আরো উত্তাল হয়ে ওঠে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং গুলিবর্ষণ, উস্কানি ও অপেশাদারী আচরণের জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচারের দাবি করা হয়েছিল। সে সব দাবির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টো সারাদেশে কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও আলেমদের উপর গণহয়রানি করা হচ্ছে। অনেককে পুরনো ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশি রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। মামুনুল হক ও শিশুবক্তা রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে জনমানসে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
দেশের পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যের অসহিষ্ণুতা ও অপেশাদারী আচরণের অভিযোগ কোনো নতুন বিষয় নয়। অন্যদের বেলায় যাই হোক, দেশের আলেম-ওলামার যে কোনো ইস্যুতে পুলিশকে সব সময়ই বাড়াবাড়ি ভূমিকায় দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন পুলিশকে যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। রাজপথ দখল করে শাহবাগে নাস্তিক ব্লগারদের আন্দোলনের সময় পুলিশকে তাদেরকে বিশেষ নিরাপত্তা দিতেও দেখা গেছে। পক্ষান্তরে হেফাজতে ইসলামের শাপলাচত্বর সমাবেশ ভন্ডুলের ঘটনা নতুন করে উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়। সে সব ঘটনা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কোনো অবকাশ ছিল না, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। দেশের নব্বইভাগ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত কওমি ওলামাদের আন্দোলন ও পুলিশি ভূমিকা নিয়ে দেশের গণমাধ্যমও যথাযথ ভূমিকা রাখছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। হেফাজত নেতা তথা কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও আলেমদের উপর গ্রেফতার অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে। পবিত্র রমজান মাস ও করোনাকালীন বাস্তবতায় সব ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক ও কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও দেশের আলেম-ওলামার গ্রেফতার-হয়রানি অব্যাহত রাখা বিস্ময়কর ও দুঃখজনক। অতীতে এর চেয়ে জটিল সময়েও হেফাজতে ইসলাম ও কওমি ওলামার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমঝোতা ও সম্প্রীতির নজির আছে। কওমি সনদের স্বীকৃতিসহ এ ধারার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও অবদানও অনস্বীকার্য। কিন্তু হেফাজতের আন্দোলনের অজুহাতে সারাদেশে কওমি ওলামার ধরপাকড় ও পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। এটি একটি বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা ও সংক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় তৃতীয় পক্ষের ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাও থাকতে পারে। নতুন করে শত শত আলেম-ওলামার তালিকা তৈরি করে গ্রেফতার অভিযানের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। দেশের চলমান বাস্তবতা এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে এটি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এ সমস্যার সমাধান এবং আলেম-ওলামার ওপর হয়রানি, গ্রেফতার ও নির্যাতন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ঈদের আগেই দেশবরেণ্য আলেমদের জামিনে মুক্তি এবং সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের আন্দোলন ও মোদিবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের বাড়াবাড়ি, গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এটা খুবই জরুরি বিষয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন