শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মা-মাছ যথেষ্ট ডিম ছাড়েনি দুই কারণে

হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরীয়া

বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

হালদা নদীতে রুই-কাতলা মা-মাছেরা সদ্য ডিম ছেড়েছে। তবে মোটেও যথেষ্ট নয়। হতাশ ডিম সংগ্রহকারী জেলে এবং মাছচাষিরা। তারা এক মাসেরও বেশি হালদা তীরে অপেক্ষায় ছিলেন কখন মা-মাছেরা ডিম ছাড়বে। ডিম সংগ্রহে জমবে উৎসব। ডিম লাখ লাখ রেণু-পোণায় পরিণত হয়ে পৌঁছে যাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। কিন্তু আশা মিটেনি। হালদার মাছের ডিম রেণু পোনা থেকে মাছ খুব দ্রুত বর্ধনশীল এবং সাইজেও অনেক বড় হয়। সারাদেশে এর চাহিদা।
এশিয়ায় মিঠাপানির রুই-কাতলা-মৃগেল অর্থাৎ কার্প জাতীয় বড় মাছের সর্বসৃহৎ প্রাকৃতিক বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর হালদা নদী। আল্লাহ কর্তৃক এদেশে প্রকৃতির বিস্ময়কর দান হালদা নদী এবং তার মিঠাপানি, মৎস্যরাজি, জীববৈচিত্র্য ছাড়াও বহুমুখী সম্পদ-সম্ভাবনার ধারক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী হালদায় এবার ডিম মিলেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি। অথচ গেল বছর আহরিত হয় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। যা গত এক যুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে। তবে অতীতে কোন কোন বছর বাম্পার পরিমাণে ডিম আহরিত হয়। আবার কোন কোন বছরে জেলেদের প্রায় খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।
এবার হালদায় মা-মাছের ডিম সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফলাফল কেন আসেনি? এ প্রসঙ্গে গতকাল (শুক্রবার) অভিমত দিয়েছেন হালদা বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি এর পেছনে প্রধান দু’টি কারণ দেখছেন। সেই সঙ্গে পরিবেশ-প্রকৃতি অনুকূল হলে এ বছর সামনের অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার ‘জো’তে মা-মাছ আবারও ডিম ছাড়তে পারে এমনটি সম্ভাবনার কথাও জানান। ড. মনজুরুল কিবরীয়ার অভিমত নিচে তুলে ধরা হলো।
গত ২৫ মে দিনগত রাত ১২টার দিকে হালদা নদীতে রুই কাতলা জাতীয় মাছ মৌসুমের প্রথমবারের মতো নমুনা ডিম ছাড়ে। একই দিন রাত ১টা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির টিম পানির গুণাগুণ পরীক্ষাসহ হালদা নদীর মাছের প্রজননের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করে আসছে। ২৬ মে দুপুর ১২টার দিকে মা-মাছ দ্বিতীয় দফায় নমুনা ডিম দেয়। সর্বশেষ ২৬ মে রাত সাড়ে ১১টা থেকে স্থানীয় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ শুরু করে।
এ বছর হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা এবং হালদা নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী থেকে শুরু করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হালদার মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে নিয়ে অন্যরকম প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। আমার দেখা বিগত ২১ বছরের মধ্যে হালদার পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং মা-মাছের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
তা সত্ত্বেও পরিবেশগত দু’টি প্যারামিটার সব হিসাব নিকাশ ওলটপালট করে দেয়। হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছের ডিমের প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি। এর অন্যতম কারণ দুইটি-
এক. এপ্রিল থেকে জুন মাস হালদার রুই জাতীয় মাছের প্রজনন সময়। এই তিন মাসের মধ্যে প্রতি মাসের আমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা তিথিতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে তখন নদীতে মাছ ডিম ছাড়ে। কিন্তু এ বছর এপ্রিল-মে দুই মাস অতিবাহিত হলেও হালদার নদীর উজান অঞ্চলে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত হয়নি। এরফলে পাহাড়ি ঢল না আসায় নদীতে মাছের ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি।
দুই. মে মাসের চতুর্থ ‘জো’ অর্থাৎ পূর্ণিমা তিথি ছিল ২৩ থেকে ২৯ তারিখ। এ সময়ে অল্প পরিমাণে বৃষ্টি হলে মা-মাছেরা ডিম ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে হালদা নদী জোয়ার-ভাটার নদী হওয়ার কারণে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এই জোয়ারের পানির সাথে হালদা নদীর পানিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
পরিবেশগত এই দু’টি বাধা-বিপত্তির কারণে হালদা নদীতে মাছের প্রজননের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। কিন্তু মা-মাছেরা ডিম ছেড়ে দেয়ার উপযোগী পরিপক্বতা হয়ে উঠার কারণে যৎসামান্য অনুকূল পরিবেশে মা-মাছেরা কিছু ডিম ছাড়তে একপ্রকার ‘বাধ্য’ হয়।
কিন্তু পুরোপুরি ও প্রত্যাশিত স্বাভাবিক পরিবেশ-প্রকৃতি বিরাজমান না থাকায় হালদা নদীতে প্রচুর মাছের অবস্থান এবং দূষণমুক্ত থাকা সত্ত্বেও রুই জাতীয় মা-মাছেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যাশিত পরিমাণে ও হারে ডিম ছাড়েনি।
তবে আমরা আশা করছি হালদার লবণাক্ত পানির দূরীকরণের মাধ্যমে এবং উজানে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত হলে পরে হালদা নদীতে মা-মাছেরা আবার দ্বিতীয়বারের মতো ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক টিম হালদা নদীতে মাছের প্রজনন সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। তাতে দেখা যায়, এ বছর ডিম সংগ্রহের জন্য নৌকার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি, যার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ টির মতো। নদী থেকে সরাসরি ডিম সংগ্রহকারী লোকের সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এবছর প্রায় ৮শ’ জন ডিম সংগ্রহকারী নদী থেকে সরাসরি ডিম সংগ্রাহে অংশ নেন। এহেন প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী এবার আহরিত মাছের ডিমের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি।
কর্ণফুলীর পর দেশের অর্থনৈতিক নদী, মৎস্য ব্যাংক হালদা। নদীটি এ বছর বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত হয়। হালদার মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, নদীর গতি সুরক্ষায় ব্যাপক নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নদীতীরে নৌ পুলিশের তদারকিতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসেছে। মাছ শিকার, বালু-মাটি তোলা, নৌকা চলাচল বন্ধসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধে দৃশ্যমান তৎপর প্রশাসন। তবে হালদায় মা-মাছের ডিম ছাড়ার পুরো বিষয়টি আবহাওয়া, পরিবেশ-প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন