চৈত্র পেরিয়ে ঢুকছে বাংলা মাস বৈশাখ। আর বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টি তথা কালবৈশাখী হলেই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মৎস্য প্রজননক্ষেত্র ঘোষিত বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে ডিম ছাড়বে কার্প জাতীয় মিঠা পানির মা মাছ। আর এ উপলক্ষে প্রস্তুত করা হয়েছে মা মাছের ডিম সংগ্রহ করতে নৌকা, নোঙ্গর, বালতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। তবে নৌকার ভাড়া বেশী হওয়ায় খরচ মেটাতে এবার এই মৌসুমে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে বাঁশের ভোরকা প্রকাশ (হাইক্কা)। প্রতিটি নৌকার পাশাপাশি রাখা হবে এ বাঁশের ভোরকা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অভিজ্ঞ বেশ কয়েকজন ডিম সংগ্রহকারি হালদা পাড়ে বসেই ভোরকা তৈরিতে ব্যস্ত। যেখানে একটি নৌকার ভাড়া পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা গুনতে হয় সেখানে মাত্র তিন হাজার টাকা খরচে তৈরি হচ্ছে ভোরকা। একইসাথে ডিম সংগ্রহের পর তৈরিকৃত ভোরকার বাঁশগুলো বিক্রি করতে পারবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। তাই ভোরকায় লোকসানের কোন ভয় না থাকায় আদি কালের মত ভোরকার দিকে ঝুঁকছে ডিম সংগ্রহকারীরা।
ডিম সংগ্রহে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ লোকমান, মো. শফি, নুর ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, গত বছর চাহিদানুযায়ী ডিম না পাওয়ায় নৌকাসহ আনুষাঙ্গিক খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হয়েছে অনেক ডিম সংগ্রহকারীর। গতবারের চেয়ে এবার নৌকা ভাড়াও দ্বিগুন। তাই বাপ দাদার আমলের বাঁশের তৈরি ভোরকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে তেমন ব্যয় হবেনা। দ্বিতীয়ত, কাজ শেষে অনায়াসে বিক্রি করে দেয়া যাবে। জানা গেছে, বর্তমানে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে ডিম ছাড়ার মৌসুম হলেও বিশ বছর আগে চৈত্র মাসেও মৌসুম ছিল। তখন বলা হত. তিন মাসে মানে তিন জোতে মা মাছ ডিম ছাড়ত। কিন্তু কালের বিবর্তনে পরিবেশ অনূকুলে না থাকায় তিন জোত থেকে এখন দুই জোতে নেমেছে ডিম ছাড়ার মৌসুম। আগের মত মহোৎসব নেই হালদা পাড়ে। প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারীদের অবহেলা, জলবায়ুর পরিবর্তনে ঋতু পরিবর্তন, ডিম সংগ্রহের সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধি, হালদার প্রকৃত তথ্য নিয়ে নোংরামি, গ্রুফিংসহ বিভিন্ন কারণে ডিম সংগ্রহকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে এ পেশা ছেড়ে জীবিকা নির্বাহে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। এদিকে, মা মাছের ডিম ছাড়ার স্থান তথা কোনের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত বিশ বছরেও যেখানে প্রায় বার থেকে পনেরটি ছিল তা আজ এসে দাঁড়িয়েছে চার থেকে পাঁচটিতে। অপরদিকে. বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় গভীরতা কমে নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ভরাট হচ্ছে ডিম ছাড়ার কোনগুলি। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ভাসা জাল বসিয়ে মা মাছ নিধন করা হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে ডিম ছাড়তে আসা মা মাছ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পরিবেশ অনূকুলে না থাকায় অনেক সময় মা মাছ ডিম না ছেড়ে তার পেটেই রেখে দিচ্ছে। মাছ খেকোরা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে।
দিন দিন ডিমের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে অভিজ্ঞরা আরো জানান, কোথায় কিভাবে কখন কোন পরিবেশে ডিম ছাড়বে, মা মাছ প্রাকৃতিকভাবে তা নির্ধারণ করে। পরিবেশ তাদের অনূকুলে না থাকলে তারা ডিম ছাড়েনা। নিরাপদ মনে না করলে দূরদূরান্ত থেকে আসাও বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট করার কারণে হালদায় আগের সেই স্রোত নেই। মৌসুমে বৃষ্টির পানি তথা শাখা নদীর পানি নিয়মনুযায়ী প্রবেশ করতে পারেনা। বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্য দূষিত করছে নদীর পানি। তৈয়্যব, শফি, নুরুল হক, ইব্রাহীমসহ অনেক ডিম সংগ্রহকারী বলেন, একসময় হালদায় অহরহ নৌকাও চলাচল করেছে। জাল দিয়ে মাছও ধরা হয়েছে। বালু উত্তোলন করা হয়েছে প্রতিনিয়ত তখন ডিমও পেয়েছে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশী। অনেকে অতিরিক্ত ডিম নদীতেই ফেলে দিয়েছে। বিক্রিত রেণু, পোনা বিক্রি করে বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছে। বিদেশ গিয়েছে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। আর এখন হ য ব র ল।
তারা বলেন, আগের ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে সঠিক পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। নদীর হারিয়ে যাওয়া স্রোত ফেরাতে স্লুইসগেট সংস্কার করতে হবে। শাখা নদী থেকে নির্বিঘ্নে পানি ঢুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে দরকার সরকারের পক্ষ থেকে বালু উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে নদীর গভীরতা ফিরে আসে। সঠিক নিয়মে জোয়ার ভাটার ব্যবস্থা করতে হবে। মাছ নিধনকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এবার প্রায় ৫শ ডিম সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ করবে। আড়াই’শ নৌকার পাশাপাশি থাকবে বাঁশের ভোরকা। উত্তর মাদার্শা আজিমের ঘাটা থেকে নাপিতের ঘাটা এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা অবস্থান নেবে। এর মধ্যে রয়েছে চার চারটি কুম। যদিও গতবার আরো কয়েকটি কুম ছিল। বিভিন্ন কারণে ভরাট হয়ে যাওয়ায় উপরোল্লিখিত স্থানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সরকারের ব্যবস্থাপনায় মাছুয়াঘোনাসহ সবকটি হ্যাচারি প্রস্তুত করা হয়েছে। আবার পাশাপাশি অনেকেই মাটির কুয়া প্রস্তুত করেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে এবার চাহিদানুযায়ী ডিম পাওয়ার আশা করছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন