খান মুজাহিদ মুহাম্মদ
ইব্রাহিম সাহেবকে অফিসে দেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিস্মিত। তিনি প্রতিদিন সকাল ৭ টায় অফিসে আসেন, আজও এসেছেন। কিন্তু, আজকের দিনটি অন্যসব দিনগুলোর মতো নয়। গতকাল ইব্রাহিম সাহেবের ছেলে মারা গেছে, দাফন এখনও হয়নি; ছেলের লাশ বিদেশে। ইব্রাহিম সাহেব উপস্থিত হয়েই ক্ষান্ত হলেন না, অফিসের কাজকর্ম যথারীতি চালিয়ে নিলেন; পূর্বনির্ধারিত মিটিং করলেন, মিটিংয়ে বক্তব্য দিলেন। তারপরে, তিনি গেলেন বিমানবন্দরে; দূরদেশে মৃত্যুবরণকারী ছেলের লাশ গ্রহণ করতে।
আমার বর্ণিত ইব্রাহিম সাহেবকে অনেকের কাছেই আবেগ বিবর্জিত অনুভূতিহীন পাষাণ মনে হতে পারে! কিন্তু, অবস্থানে তিনি তো সাধারণ নন, সাধারণের আদর্শ বরঞ্চ। এককথায় অসাধারণ।
অসাধারণের মধ্যে অল্প-স্বল্প অস্বাভাবিকতা থাকেই। অস্বাভাবিকতাটুকু অসাধারণত্বের চিহ্ন হয়তো-বা! তাছাড়া, ইব্রাহিম সাহেব পেশায় চিকিৎসক। মৃতকে নিয়ে তার তেমন কিছু করার নেই। মূলত জীবিতদের নিয়েই তার চিন্তাজগত। সব রোগীই তার সন্তান। এক ছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকলে ইব্রাহিম সাহেবের চলবে?
না, গল্প নয় এটা; ইব্রাহিম সাহেব চরিত্রটি কল্পিত নয়। তিনি মাটির পৃথিবীর মানুষ। তার পুরো নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম। উল্লিখিত অফিসটি হলো আজকের বারডেম হাসপাতাল। হ্যাঁ, বিশ্বখ্যাত চিকিৎসাবিদ জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কথাই বলছি।
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে সমোধিক পরিচিত শেখ আবু মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯১১ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুরের খাঁড়েরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মুহম্মদ কিসমতুল্লাহ, মাতা আজিম উন-নিসা বিবি। পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান ইব্রাহিমের শৈশবকাল গ্রামেই অতিবাহিত। গ্রামের পাঠশালায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে সালার এডওয়ার্ড হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি, সেখান থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন; ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে।
১৯৩৮ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে সেখানেই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ভারত বিভক্তির পরে তিনি পূর্বপাকিন্তানে চলে আসেন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন পদে যোগ দেন প্রথমে। কিছুদিনের মধ্যেই ইব্রাহিম যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে এমআরসিপি এবং পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমসিসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন ডা. ইব্রাহিম। ক্রমান্বয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হন। এ প্রতিষ্ঠানে চাকরিকালীন তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সেগুনবাগিচায় ‘পাকিস্তান ডায়াবেটিক সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বাধীনতার পরে যা ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি’ নামে পরিচিত। মাত্র ১৩ জন নিবন্ধিত রোগী নিয়ে যাত্রা শুরু করা ডায়াবেটিক সমিতির সেবায় উপকৃত দেশ-বিদেশের কোটি মানুষ। বর্তমানে সারাদেশে ডায়াবেটিক সমিতির নিয়মিত (কার্ডধারী) সেবাগ্রহীতা ৫ লক্ষাধিক। এ সমিতি প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে বহুমূত্র রোগের চিকিৎসা প্রায় অপ্রচলিত ছিল। উপমহাদেশে বহুমূত্র রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও এর চিকিৎসা প্রচলনে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রাতঃস্মরণীয়। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত বারডেম হাসপাতাল (অধূনা : ইব্রাহিম মেমোরিয়াল হাসপাতাল; প্রতিষ্ঠা: ১৯৬৫ খ্রি.) ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অমরকীর্তি।
আমাদের দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ তিনি। বারডেম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ডা. ইব্রাহিম সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অতিগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নিরলস কাজ করেছেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। মন্ত্রী-পদমর্যাদায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা, ঢাবি’র সিনেট সদস্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) এশিয়া অঞ্চলের উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্যÑ এরকম অসংখ্য পদ অলংকৃত করেছেন বিংশ শতাব্দীর আলোচিত এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী।
সুদক্ষ সংগঠক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত। চিকিৎসা সেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ‘সিতারা-ই-খিদমত’ উপাধি দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে। ১৯৮৪ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন। চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যাকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। এসবের বাইরে তিনি মওলানা আকরাম খাঁ স্বারক স্বর্ণপদক (১৯৯১ খ্রি.), ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৮৯ খ্রি.), খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ স্বারক স্বর্ণপদক (১৯৮৭ খ্রি.) ও কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৮৬ খ্রি.) লাভ করেন।
পারিবারিক জীবনে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী অধ্যাপিকা ড. নীলিমা ইব্রাহিম বাংলা একাডেমির প্রাক্তন (প্রথম ও এযাবৎ একক নারী) মহাপরিচালক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্বনামখ্যাত শিক্ষক। সাহিত্যিক হিসেবেও ড. নীলিমা সুপরিচিত। ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর উপমহাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রের মহীরুহ, গভীর জীবনবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, প্রবাদ প্রতিম চিকিৎসক, জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ডা. ইব্রাহিম আজ নেই, কিন্তু তার জীবন ও কর্ম রয়েগেছে আমাদের মাঝে।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর
সশযধহ.ষরঃব@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন