রাজু আহমেদ
মৌলভীবাজারের মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা আবু সুফিয়ান। বর সেজে বাবা-ভাইকে সাথে নিয়ে মাইক্রোবাসে ঢাকায় যাচ্ছিলেন জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে। চোখে মুখে রঙিন স্বপ্ন ঝলকানি দিচ্ছিল অবিরাম। অথচ সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেলো একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়। মেহেদী হাতে বরের অপেক্ষায় থাকা কনেটি নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। আনন্দ-উল্লাসের পরিবেশে নেমে এলো শোকের ছায়া। বি-বাড়ীয়ায় বিপরীত দিক থেকে আসা দূরপাল্লার দ্রুত গতির একটি বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে বরসহ দুর্ঘটনা স্পটেই নিহত হল সুফিয়ান পরিবারের ৮ সদস্য। জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি অমোঘ। কিন্তু সে মৃত্যু যখন হয় সড়ক দুর্ঘটনায় তখন কষ্টের শেষ থাকে না। কেননা, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সড়ক যেন একেকটি মৃত্যুকূপ। সড়কের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন রক্ত ঝড়ছে, জীবন কেড়ে নিচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর ভাসছে। নিকট অতীতের বছরগুলোর চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা হ্রাস পেলেও ঈদুল আযহার আগে-পরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে ঈদের আগে-পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৩০-১৫৮ জন। আহত হয়েছে হাজারের বেশি। শতাধিক পরিবার তাদের পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। চালকদের বেপারোয়া গতি, বেশি মুনাফা লাভের মানসিকতা, ফিটনেসবিহীন যানচলাচলের সুযোগ, সড়ক-সহাসড়কের বেহাল অবস্থা, ট্রাফিক সিগন্যাল অবজ্ঞা, আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থার অভাব সর্বোপরি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গত বছরের ১ আগস্ট দেশের ২২টি সড়কে তিন চাকার যানবাহন নিষিদ্ধ এবং দূরপাল্লার বাসের গতি সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমটির নির্ধারণ করা হলেও বেশিরভাগ সড়কে এ নীতির তোয়াক্কা করেনি চালকরা এবং কর্তৃপক্ষের ঈদ উদযাপনের ব্যস্ততায় দায়িত্বের অবহেলা দুর্ঘটনাকে ত্বরান্বিত করেছে।
নাড়ির টানে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল এবং ঈদ উদযাপন শেষে কাজে ফেরার তাগাদায় ঈদের কয়েকদিন আগে-পরে সড়কে যাত্রীর বাড়তি চাপ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবহন মালিক ও চালকদের আইনের তোয়াক্কা না করার ব্যাপারটি। গাড়ির চালকদেরকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না দেওয়া, অদক্ষ চালকদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরানোর ক্ষমতা দেয়া, বছরের অন্যান্য সময়ের লোকসান উসুলের জন্য মালিকপক্ষ কর্তৃক চালকদেরকে মানসিক চাপে রাখা, চালকদেরকে পরিমিত বিশ্রামের সুযোগ না দেয়াসহ আরও বহুবিধ কারণে বছরের এ সময়টাতে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলাফলে, ঈদের আনন্দ শোকের মাতমে রূপ নেয়। পঙ্গুত্ববরণসহ কর্মহীন-রুজিহীন হয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। প্রত্যেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় কোটি কোটি টাকার লোকসানিতে পড়ে দেশ। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীর প্রায় ২৫ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতরা। গত এক যুগের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সর্বমোট মৃত্যুর সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনার পরিণতি। প্রতি বছর শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে গাড়ির সংখ্যা ও মৃত্যুর আনুপাতিক হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অবিশ্বাস্য রকম বেশি। আমেরিকায় প্রতি ১০ হাজার গাড়ি ২ জন লোকের মৃত্যু ঘটায়। ওরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালায়, ওদের রাস্তা সুপরিসর এবং সেখানে ভূয়া লাইসেন্সের ড্রাইভার নেই। সর্বোপরি ওদের ট্রাফিক পুলিশ দুর্নীতিপরায়ণ নয়, বরং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিত্রের মধ্যে পাকিস্তানে প্রতি ১০ হজার গাড়ির বিপরীতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয় ১৯ জনের, ভারতে ২৫ জন। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার গাড়ি ৬০ জনের মৃত্যু ঘটায়। সড়ক দুর্ঘটনার ঘটার পর যেগুলো মর্মান্তিক হয় সেগুলোতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখি। অনেক সময় ক্ষতি পূরণের আশ্বাসবাণীও শুনি, ক্ষতি পূরণ দিয়েও থাকেন; তবে সব ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু যে ক্ষত দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারগুলোর জীবনে সৃষ্টি হয়, তা কি কখনো শুকায়? যারা পঙ্গুত্ববরণ করছে, রাষ্ট্র কী দায়িত্ব নিচ্ছে তাদের?
অতীতের বছরগুলোর তুলনায় নিকট অতীতের বছরে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার লোকা মারা গেছে উল্লেখ করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে ‘নিসচা’। নিসচার প্রদত্ত তথ্য মতে, ২০১৫ সালে সারা দেশে ২ হাজার ৬২৬ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩ জন জন মারা যান এবং আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। ২০১৪ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২ হাজার ৭১৩টি এবং নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজা ৫৮২ জন। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ পায়, ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি (৩৫৯ জন) নিহত হন এবং সবচেয় কম (২৮ জন) নিহত হয় কুষ্টিয়া জেলায়। অতীতে সড়ক দুর্ঘটনা ও তার কারণ নিয়ে আমরা সেতুমন্ত্রী ও স্বররাষ্ট্রমন্ত্রীর বচসাও দেখেছি। একজন আরেকজনকে দায়ী করেছেন। কেউ বলেছেন ট্রাফিক ব্যবস্থা দায়ী, কেউ বলেছেন রাস্তা দায়ী। ট্রাফিক ব্যবস্থা দায়ী না যোগাযোগ ব্যবস্থা দায়ী? পুলিশ দায়ী না ইঞ্জিনিয়ার দায়ী? জনগণের কাছে এসব মুখ্য নয়। আমরা নিরাপদ সড়ক চাই, চাই নিরাপদ বাহন। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, দুর্ঘটনার অপমৃত্যু নয়। মোটকথা, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা দরকার। সেটা কোন মন্ত্রণালয় করবে বা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে করবে কিনা, তা নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের।
বাংলাদেশে যেসব প্রতিবন্ধকতাগুলোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয় তার মধ্যে সরু রাস্তা ও রাস্তায় ডিভাইডার না থাকা, পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের সুযোগ, উন্নতমানের ও টেকসই সড়ক নির্মাণ না করা, অদক্ষ চালককে লাইসেন্স প্রদান, ড্রাইভিং পেশার উৎকর্ষহীনতা, সনাতনী ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থায় কাজ চালানো, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনার অভাব, বিকল্প যানবাহনের (রেল, লঞ্চ ইত্যাদি) সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকা এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাব।
আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ৩০ কোটিতে পৌঁছবে অথচ দেশের ভূমির পরিমাণ বাড়বে না এক ইঞ্চিও। সুতরাং এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় চরম ধ্বসের আশঙ্কা ক্রমশ প্রবল হবে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘায়িত হবে। অতি সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের সাধারণ মানুষ আইন মানলেও যারা ‘অসাধারণ’ তারা আইন কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। বর্তমান সরকারের যতজন মন্ত্রী তাদের দায়িত্ব পালনে সফল এবং জনগণের কাছে ক্লিন ইমেজ ধরে রাখতে পেরেছেন তাদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের চৌধুরী অন্যতম। অথচ এই সফল মন্ত্রীও অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি সড়ক দুর্ঘটনার লাঘাম টানতে পারছেন না এবং সড়ক দুর্ঘটনার দায় তারও। যারা আইন মানছেন না এবং যাদের কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে, মন্ত্রীর ভাষায় সেই সব অসাধারণ মানুষগুলো রাজনৈতিক ব্যানারের। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি দল ছাড়া অন্য কোনো দলের নেতা-কর্মীর অসাধারণের ভূমিকা নেওয়ার অবস্থা আপাতত নাই। মন্ত্রীর দৃষ্টিতে যারা অসাধারণ তার প্রায় সর্বাংশ সরকারি দলের। কাজেই তাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা দলের উচ্চ পর্যায় থেকেই নির্ধারিত হতে হবে। এটা যদি হয় তবে সড়ক দখল বাণিজ্যসহ সড়ক পথের অনেক জরা কেটে যাবে এবং রোধ হবে সড়ক দুর্ঘটনা, কমে আসবে লাশের সংখ্যা।
সব কিছুর পরেও মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যত ব্যবস্থাই আমরা নেই না কেন, দুর্ঘটনা কমানো যাবে কিন্তু বন্ধ করা যাবে না। তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বরোধে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে প্রাথমিক ও জরুরি পরিচর্যার। দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানের সড়ক যেভাবে প্রশস্থ করা প্রয়োজন তা করতে হবে, রাস্তায় ডিভাইডার দিতে হবে, তেমনি সে অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন হেলথ সেন্টার, সাব সেন্টার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যকর্মীদের দুর্ঘটনা-পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমানÑএ বাক্যের যথাযথ প্রয়োগ সবার মধ্যে আনতে-মানতে বাধ্য করতে হবে। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট
ৎধলঁ৬৯ধষরাব@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন