সারাদেশে কঠোর লকডাউনের মধ্যেই হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর আতঙ্কের মধ্যেই রাজধানী ঢাকায় বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। এরই মধ্যে বর্ষায় অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন জনপদ তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর ও ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে নদী-ভাঙ্গনের তীব্রতা। বন্যা ও ভাঙ্গনকবলিত অনেক মানুষ নিজেদের ফসলি জমি, ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। লকডাউনে কর্মহীন লাখ লাখ মানুষের সাথে যোগ হচ্ছে বন্যা ও নদীভাঙ্গনের শিকার আরো হাজার হাজার পরিবার। সামগ্রিক বাস্তবতায় দেশ এখন এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একদিকে করোনা সংক্রমণের বিপজ্জনক ঊর্ধ্বগতি, ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মিছিলের সাথে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। জুন মাসের শেষ ১১ দিনে রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫ জন হাসপাতালে ভর্তির খবর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সোমবার একদিনেই রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৩৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
বন্যা, নদীভাঙ্গন ও মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরের মতো সমস্যা কোনো নতুন ইস্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এসব সংকট মোকাবেলা করছি। বন্যা ও নদীভাঙ্গনে প্রতিবছর হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ার মতো সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের তাকিদ ও পরিকল্পনার কথা হয়েছে অনেক। প্রতিবছরই এসব খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। সবক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার অভাব, দুর্নীতি, লুটপাট ও সমন্বয়হীনতার চিত্র উঠে আসে। এসব কারণেই নদীভাঙ্গন, টেকসই বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের মতো উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে না। গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের সুফল জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তার এই সদিচ্ছা ও নেতৃত্বের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হলে যে ধরনের সৎ, যোগ্য ও নির্ভরশীল আমলাতন্ত্র দরকার তার অনুপস্থিতির কারণেই বেশিরভাগ সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সবক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে সংকট ক্রমশ তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অতি দরিদ্র জনসংখ্যার হার কমছে না। নদীভাঙ্গন ও দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের কারণে দেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সে মহতি উদ্যোগকেও নানাবিধ দুর্নীতি, অপকর্ম ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে কলঙ্কিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে জড়িয়ে থাকা এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি এসব অপকর্মের সাথে জড়িত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নানাবিধ সংকট মোকাবেলা করে দেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমেই দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে বিদায় করতে হবে। দেশের চলমান সংকট মোকাবেলায় বিদ্যমান আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করলে সফলতা আসবে না। এ মুহূর্তে করোনা লকডাউনে কোটি মানুষের অর্থনৈতিক সংকট মোচন, ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যথার্থভাবে কার্যকর রাখার উদ্যোগের পাশাপাশি রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। বৃষ্টি ও বন্যায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে পানিবদ্ধতার দুর্ভোগ মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা ও নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো পরিবারের আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত রাখার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতির জন্য সময়টা খুবই চ্যালেঞ্জিং। করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট মানুষের জীবনের হুমকি, অর্থনৈতিক সংটের পাশাপাশি ডেঙ্গুসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে সংকট উত্তরণে যে ধরনের ত্বরিৎ উদ্যোগ, প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা থাকা দরকার তা নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এ সময়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের সব স্থানীয় প্রশাসনকে মশানিধন ও পরিচ্ছন্নতা বিধানের নিজস্ব কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এই জাতীয় দুর্যোগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী, ডাক্তার ও স্বাস্থ্য বিভাগের হাজার হাজার কর্মী রাতদিন কাজ করে চলেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক সৎ, যোগ্য ও মেধাবি কর্মকর্তা রয়েছেন। এদেরকে কাজে লাগাতে হবে। অপেশাদার ও অযোগ্যদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি সৎ ও যোগ্যদের নির্বাচিত করে জাতির এই ক্রান্তিকালে কাজে লাগানো ও সমন্বয়ের মূল কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শনের এটা একটা যথার্থ সময়। দেশের মানুষ আশা করে, তাঁর অসাধারণ নেতৃগুণ, দক্ষতা ও যোগ্যতায় চলমান সংকট থেকে দেশের উত্তরণ ঘটবে। নিজের সততা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংকট মোকাবেলা করে দেশকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জে তিনি সফল হবেন। করোনা মহামারি, ডেঙ্গু, অর্থনৈতিক সংকট, বন্যা ও নদীভাঙ্গনের কবলে চরম দুর্ভোগের শিকার কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়াস একান্তভাবে প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন