উপকূলীয় এলাকায় সাগরের করালগ্রাস থেকে জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বেড়ীবাঁধ। তাই উপকূলীয় জনপদের সুরক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত এই বেড়ীবাঁধ। এই গুরুত্ব বিবেচনায় বেড়ীবাঁধ সংস্কারে প্রতিবছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে এই বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও বেড়ীবাঁধ সংস্কারে ব্যয় করা হয়না। আর যা হয় তাও সময়মত হয়না। এতে করে যথাযথভাবে সংস্কার হয়না বেড়ীবাঁধ। দুর্যোগ থেকে রক্ষা পায়না উপকূলের জানমাল ও সহায় সম্পদ। এ যেন 'নুন আনতে পান্থা ফুরাবার অবস্থা'।
জানা গেছে, কক্সবাজার উপকূলে টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া ও পেকুয়া পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ আছে ৫৯৫ কিমি। আর পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লোইস গেইট আছে ২৫৩টি।
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উপকূলে জানমাল রক্ষায় তৎকালীন সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল উপকূলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, টেকসই বেড়ীবাঁধ ও সবুজ বনায়নের। সেই থেকে উপকূলে প্রচুর সবুজ বন তৈরী হলেও বনদস্যুরা তা কেটে চিংড়ি ঘের করে। কয়েক শত সাইক্লোন শেল্টার পড়ে আছে অরক্ষিত। আর টেকসই বেড়ীবাঁধ যেন অধরা স্বপ্ন। সেই থেকে এই পর্যন্ত বেড়ীবাঁধ নির্মাণ নিয়ে চলে আসছে লুটপাটের মহোৎসব।
গত পূর্ণিমার জোয়ারের সময় এবং গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি পাতের সময় বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বেড়ীবাঁধের।
সম্প্রতি আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে সাগরে পানি বেড়েছে অস্বাভাবিক।
গত চারদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যায় কক্সবাজার উপকূলে প্রায় ১০০ কি.মি. বেড়িবাঁধে দেখা দিয়েছে ভাঙন। আর এই ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে সহায় সম্পদের প্রচুর ক্ষতি করছে।
কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ও হৃীলার বিস্তীর্ণ এলাকা পূর্ণিমায় জোয়ারের পানিতে তলীয়ে গেছে। এসব এলকার ভাঙা বেড়িবাধের অর্ধশতাধিক পয়েন্টের ভাঙা দিয়ে সাগরের পানি ঢুকে সেখানে চলে জোয়ার-ভাটা। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে এই বেড়িবাঁধ সংস্কার নাহওয়ায় লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পানিবন্দি হয়ে পড়ছে ওখানকার হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতির মুখে পড়েছে ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি, মসজিদ-মাদরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে বেড়েই চলেছে জনদূর্ভোগ।
গত চার দিনের ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও ভরা জোয়ারের ৪/৫টি এলাকায়া বেড়ীবাঁধ ভেঙে পানিতে একাকার হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। মাতামুহুরী ও বঙ্গোপসাগরের শাখা নদীতে বাড়ছে পানির উচ্চতা। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ।
ভরা জোয়ার ও লঘু চাপের প্রভাবে সাগরে উচ্চতা বেশি থাকায় স্লুইচ গেট দিয়ে পানি নামছে না। এদিকে বেড়িবাঁধের চকরিয়ার ভাঙ্গার মুখ থেকে ঘুনিয়া অংশেও ভাঙ্গনের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানা গেছে। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামস তাবরীজ ও চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী এলাকা পরিদর্শন করেছেন।দেরীতে হলেও এমপি আলহাজ্ব জাফর আলমের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সহায়তায় সুইচ গেট গুলো খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
কুতুবদিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, কুতুবদিয়া প্রাকৃতিকভাবে প্রায় ১০ ফুট উচ্ছতায় বেড়ীবাঁধের মত দ্বীপ। এটি রক্ষা করা না গেলে পেকুয়া, মগনামা ও বাঁশখালীসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা সাগরের করাল গ্রাসে পড়বে। কুতুবদিয়ার কারণে এসব এলাকা এখন রক্ষা পাচ্ছে। দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে আলী আকবর ডেইল এলাকার চার কিমি বেড়ীবাঁধ অরক্ষিত। ওই এলাকায় সাগরের জোয়ার ভাটা চলে। তিনি বলেন কয়েকটি ইউনিয়নে চাষাবাদ হবেনা। দ্বীপের দেড় লাখ মানুষ শঙ্কিত। পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে দ্বীপের চার পাশে টেকসই বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করার দাবী জানান তিনি।
কুতুবদিয়া উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসম শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, কুতুবদিয়ায় বেড়ীবাঁধের অবস্থা যেন-'নুন আনতে পান্থা ফুরাবার অবস্থা'। দীর্ঘ ৮ বছর পর তাঁর এলাকার কায়সার বাপের পারার বড় ভাঙাটি সংস্কার হয়েছে। কিন্তু বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আলী আকবর ডেইলের ৬ কিমি এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এখানে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ।
এ প্রসঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মহেশখালী-কুতুবদিয়ার বেড়ীবাঁধ সংস্কার ও জানমাল রক্ষায় আমরা আন্তরিকতার সাথে কাজ করছি। মহেশখালী ধলঘাট এলাকা বেড়ীবাঁধ ৯১ সালে সম্পূর্ণ সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ওখানে ৭০ ফোল্ডার এলাকায় টেকসই পার্মেনেন্ট বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া কুতুবদিয়ার ৪০ কিলোমিটার এলাকার ১৪ কিলোমিটার কাজ হয়েছে। এবং সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়ীবাঁধ জরুরী ভিত্তিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন