মানুষের মুখ দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ,আনন্দ-বেদনা বোঝায় যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার চেহারা দেখেও দেশটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে ঢাকার সুনাম না থাকলেও পৃথিবীর দূষিত শহরের বদনাম আছে। এই বদনাম আমরা ঘোচতে পারব কি না জানি না। কিন্তু সরকার উদ্যোগী হলে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির মতো পরিচ্ছন্নতার নজির স্থাপন করতে পারে। উন্নত বিশে^র দেশগুলোর রাস্তা সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওই সব দেশের রাস্তা একবার দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। অথচ আমাদের দেশের রাস্তার বেহালদশা দেখে আফসোস করা ছাড়া গতি থাকে না।
পোশাক কতটা মূল্যবান সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিনা। অপরিচ্ছন্নতা কেউ পছন্দ করে না। সবাই সুন্দর নির্মল পরিবেশে থাকতে চায়। কিন্তু সুন্দর ও নির্মল পরিবেশ গড়ে তুলতে যে পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন তা বেমালুম ভুলে যায়। আমাদের দেশের রাস্তায় মানুষ ও যানবাহন যেমন চলাচল করে তেমনি উন্নত বিশে^র রাস্তায়ও মানুষ, যানবাহন চলাচল করে। অথচ সেসব দেশ নোংরা ময়লা আবর্জনায় পরিণত হয় না। একেবারে বিপরীত চিত্র। এর কারণ কি? কারণ একটাই আমাদের বদঅভ্যাস। ঢাকা শহরের দিকে তাকালে মনে হবে আবর্জনার নগরী। যে দিকে চোখ যাবে সেদিকে ময়লা-আবর্জনা। পৃথিবীর সব ধর্মই পরিচ্ছন্নতার পক্ষে। ইসলাম ধর্মের বিধানই হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা। অপরিচ্ছন্ন থাকার সুযোগ নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৩)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা এমন দুইটি কাজ হতে বিরত থাক যা অভিশপ্ত। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: ইয়া রাসূল্লাল্লাহ! সেই অভিশপ্ত কাজ দুইটি কি? জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের যাতায়াতের পথে কিংবা ছায়াযুক্ত স্থানে (বৃক্ষের ছায়ায় যেখানে মানুষ বিশ্রাম গ্রহণ করে) পেশাব-পায়খানা করে (আবু দাউদ, হাদিস নং-২৫;)। অথচ আমাদের দেশে কিছু মানুষ পথের ধারে অথবা ফুটপাতে প্রশ্রাব-পায়খান করে। কোনো কোনো রাস্তার অবস্তা তো এত করুণ যে দুগন্ধে হাঁটা যায় না। নাকে রুমাল চেপে কোনো মতে ওই স্থান অতিক্রম করতে হয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এরকম রাস্তার ধারে পেশাব করার রীতি আছে কিনা জানা নেই।
করোনা মহামারি গোটা বিশ^কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। একসময় যারা নিজেদেরকে সুপার পাওয়ার বলে জিগির তুলতো তারাও আজ বিপর্যস্ত। গবেষকদের ভাষ্যমতে করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ হল নিজেকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। অথচ আমরা অনেকে হেলায় ফেলায় অপরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলার কাজটি করছি। হোক সেটা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। নিজে এবং নিজের আশপাশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মানদÐে আমাদের দেশের অবস্থান কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। কারণ, আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি। বাদামের খোসা, কলার খোসা, চিপসের প্যাকেট, পানের পিক, পলিথিন রাস্তায় ফেলি। বাসার উপর থেকে ময়লা রাস্তার উপর ফেলি। এসব কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোগ জীবাণুর বিস্তার ঘটছে। রাস্তা অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার পাশেই ময়লার ডাস্কবিন থাকলেও সময়মত এগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে না।
দেশ উন্নত হলেই রাস্তা পরিচ্ছন্ন হয় না। পরিচ্ছন্ন হতে হলে সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা লাগে। যেসব দেশ পরিচ্ছন্নতার মানদÐে উর্ত্তীণ হয়েছে সেসব দেশ কিন্তু এমনি এমনি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেনি। জাপানের কথাই ধরুন। জাপানে কিন্তু কোনো ডাস্টবিন কিংবা পরিচ্ছন্ন কর্মীবাহিনী নেই। এরপরও দেশটি পরিচ্ছন্ন দেশের তালিকায় রয়েছে। সেখানে যারা বেড়াতে যান তারা অবাক হন ময়লা ফেলার ডাস্টবিন না দেখে। কারও কারও কাছে অবিশ^াস্য মনে হয়। কিন্তু অবিশাস্য হলেও সত্য যে, জাপান সরকার পরিচ্ছন্ন দেশ গড়েছে। সেখানকার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও পরিছন্নতা কার্যক্রমকে শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নেয়। জাপানের স্কুলগুলোতে ক্লিনিং রোস্টার চলে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা জাপানের জন্য কোনো বীরত্বের কাজ নয়, এটি তাদের স্বাভাবিক চর্চা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ^কাপে জাপান সমর্থকরা স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে বিশ^বাসীর নজর কেড়েছিল। এ ঘটনাটি সেসময় ভাইরাল হয়েছিল। এছাড়াও আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির কথা বলা যায়। ১৯৬২ সালের ১ জানুয়ারি রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ১৯৯৪ সালের দিকে জাতিগত দাঙ্গায় প্রায় ১০ লাখের ওপরে মানুষের মৃত্যু হয়। এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও কিগালি আজ পরিচ্ছন্নতার উজ্জ্বল রোল মডেল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কিগালি ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দেশটির রাস্তায় কিংবা ফুটপাতে আবর্জনা তো দূরের কথা, ছোট কাগজের টুকরা পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখা যায় না। গন্ধযুক্ত ময়লা-আবর্জনার কথা তো চিন্তাই করা যায় না। অথচ দেশটির রাজধানী ১২ বছর আগেও আফ্রিকার অন্য শহরগুলোর মতোই অপরিষ্কার ছিল। কিন্তু এখন কিগালিকে আফ্রিকার সিঙ্গাপুর বলা হয়।
পরিচ্ছন্নতার বহু উপকারিতা আছে। তা লিখে শেষ করা যাবে না। পরিচ্ছন্নতা স্বাস্থ্যবিধি চর্চার মূলনীতি। পরিচ্ছন্নতা শুধু অন্যের উপকার করে না, নিজেরও উপকার করে। শরীরের জীবাণু সংক্রমণ রোধ করে শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পরিচ্ছন্নতার প্রভাব আছে। পরিচ্ছন্নতা মনকে হালকা করে। মানসিক অবসাদ বিতাড়িত করে। মানসিক প্রশান্তি বয়ে আনে। নোংরা পরিবেশে যেখানে কাজ করতে দম বন্ধ হয়ে আসে সেখানে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কাজ করতে উৎসাহ জাগে। সুতরাং একটি উন্নত ও রুচিশীল জাতি হিসেবে বিশে^র দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতার মানদÐে উর্ত্তীণ হওয়া প্রয়োজন। এই জন্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র অপরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা এবং স্কুল, কলেজ, মাদরাসার পাঠ্যপস্তুকে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক বিশেষ কোর্স চালু করা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন