শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু : অনুপ্রেরণার বাতিঘর

এন আই আহমেদ সৈকত | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৭ এএম

একটি শোষিত ও পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার দিয়ে গেছেন যে মহামানব, তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর। আজীবন গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার থাকা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য জীবনটাই উৎসর্গ করে গেছেন। জীবনের বহু বসন্ত তিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে কাটিয়েছেন। কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সরব।

বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তির উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ্রকণ্ঠ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের তার ভাষণ গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে, স্বাধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। ওই ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, একবিন্দুতে মিলিত করেছে। এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ৭ মার্চের ভাষণেই রচিত হয়েছে বাঙালির মুক্তির নির্দেশনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়া, জীবন উৎসর্গ করা সবটাই সেই নির্দেশনারই বাস্তবায়ন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক ধরনের মন্ত্রমুগ্ধতা ছিল। তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আশা-আকাক্সক্ষা পড়তে পারতেন। সে কারণে তাঁর গণমানুষপন্থী সব বক্তব্যেই সাধারণ মানুষ জেগে উঠতেন। মূলত ইংরেজ শাসন আমলেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মুক্তি। তিনি আশা করেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে হয়তো তা সম্ভব হবে। তাই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই যখন ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের বিরোধের সূত্রপাত হয় তখনই তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি, যা ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ নামে একটি অসা¤প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয়।

বাল্যকাল থেকেই তিনি যে রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছিলেন, সেটি সব সময় ছিল মানুষের পক্ষে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মানব মুক্তি আর শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার। তার চিন্তার অপরিহার্য অনুষদ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্ত করার বিষয়। বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তির আন্দোলনের শুরু হয় ১৯৪৭ সালের পর থেকেই, যদিও চূড়ান্ত রূপটি আসে আরও পরে। দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ভারতভাগের পর থেকেই এক নতুন অধ্যায়ের পথে যাত্রা শুরু করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। কেননা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও বাঙালি তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকদের বিরামহীন বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয় কোটি কোটি বাঙালি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। বাঙালি জাতির অবরুদ্ধ থাকার, অধীন থাকার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতো। কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই ধরুন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালের এক সাক্ষাৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ ডেভিড আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার দুর্বল দিকটা কী?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিলো, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত সমৃদ্ধ মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের দেয়ালে বুলেটের চিহ্ন এবং বঙ্গবন্ধু যে সিঁড়িতে গুলির আঘাতে পড়ে গিয়েছিলেন, সেই স্থান দেখে বিশ্বনেতাদের অনেকেই মর্মাহত হয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাদুঘর পরিদর্শন করে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ কারণেই মৃত্যুর ৪০ বছরের বেশি সময় পরও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা করা হয়।’ গত বছরের জানুয়ারিতে এসে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো মন্তব্য বইয়ে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবজাতির জন্য ছিলেন অনুপ্রেরণার বাতিঘর।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনায় আহমদ ছফার উদ্ধৃতি তুলে ধরলে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্ব তরুণ প্রজন্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। আহমদ ছফা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা সম্বোধন করতেন না, লিখতেন বাংলাদেশের স্থপতি। এটারও ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘গত তিন হাজার বছরে বাংলার ইতিহাসে শেখ মুজিবের মতো মানুষ একজনও জন্মায়নি।’ এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক- অভিন্ন।
কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আরেক নাম রেখেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’ এক অর্থে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের ইতিহাস। তার জীবন ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ সময়ের কথা আমরা জানতে পারি। শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টার অবদান অম্লান রবে চিরদিন।
লেখক: উপ তথ্য ও যোগাযোগ (আইটি) বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। সাধারণ সম্পাদক, একাউন্টিং এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন