সারা পৃথিবীতে প্রশ্ন একটাই, কবে আবার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। দেড় বছর অতিক্রম হতে চলল, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এমন কথা বলার সময় কবে আসবে তা অজানা। রোগে ভুগে মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি অনেকে মারা যাচ্ছে শোকে, হতাশায় ও ক্ষুধায়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট নরমালসি ইনডেক্স বা স্বাভাবিকতা সূচক প্রণয়ন করেছে। আটটি উপসূচকের সাপেক্ষে তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে, কোন দেশ কতটা স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে। ৫০টি দেশ নিয়ে তারা এ জরিপ করেছে। তাতে বাংলাদেশ নেই। মারাত্মক সংক্রমক ডেলটা ভেরিয়েন্টের আঘাতে জেরবার বাংলাদেশ। কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করেছে। সেখানে এই করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যেও পরিবহণ, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ছোট শিল্প খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে বলে দাবি করছে সংস্থাটি, তাতে সাময়িক (৮-৯ মাসের) হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং চ‚ড়ান্ত হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা ২০১৯-২০ সালের সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই বিবেচনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের চ‚ড়ান্ত প্রবৃদ্ধি কত হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর করোনাময় এই দুই অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিগত কত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তা পিছনের পাতায় খুঁজতে হবে। আর এই যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক তখন প্রায় প্রতি কার্যদিবসেই রেকর্ড গড়েছে শেয়ারবাজার। আগে আর্থ-সামাজিক সব সূচকই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু শেয়ারবাজারের সূচক ছিল স্থবির। শেয়ারবাজার এখন স্থবিরতা কাটিয়ে চাঙ্গা হয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত। শেয়ারবাজারে চলছে একের পর এক রেকর্ডের মহোৎসব।
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্সকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাছাই করা ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ও শরিয়াভিত্তিক ডিএসইএস সূচক দুটিও সর্বোচ্চ উচ্চতায় রয়েছে। গত ১৬ আগস্ট ডিএসইতে প্রায় ১০১ কোটি ৪৭ লাখ শেয়ার হাতবদল হয়েছে। এর আগে ডিএসইতে একদিনে কখনো শতকোটি শেয়ারের হাতবদল হয়নি। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বেশি শেয়ারের লেনদেন হওয়া মানে বাজারে বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়া। ফলে ২০১০ সালের পর সর্বোচ্চ (২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা) লেনদেন হয়েছে ওইদিন। বাজার মূলধনও বেড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার ওপরে। করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য না বাড়লেও বিমা ও পোশাক খাতের শেয়ারের দর টানা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বছরের পর বছর লোকসানে থাকা, এমনকি উৎপাদনে না থাকা কোম্পানির শেয়ারের দরও বেড়েছে। অন্যদিকে ‘ব্লু-চিপ’ হিসেবে পরিচিত ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের দর অবমূল্যায়িত। তাই এটিকে কেউ কেউ ‘সিঁদুরে কালো মেঘ’ হিসেবে দেখছেন। এই উত্থানকে কীভাবে টেকসই করা যায়, সেটি ভেবে দেখতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের শেয়ারবাজার কি অতি-মূল্যায়িত? সাধারণত ঝুঁকি বিবেচনায় সর্বপ্রথম যে নির্দেশকটি দেখা হয় সেটি হচ্ছে প্রাইস আর্নিং (পিই) রেশিও বা মূল্য আয় অনুপাত। বলা হয়ে থাকে, ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের পিই রেশিও সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে, যা এখন বাংলাদেশের বাজারে ১৯ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট। এখানে আরও অধিকতর খতিয়ে দেখার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মোট ২১টি খাতের কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। ডিএসইর পিই রেশিও বলতে সব খাতের গড় পিই রেশিও বোঝায়। খাতভিত্তিক পিই রেশিও বিবেচনা করলে অনেক খাতের পিই রেশিও অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বস্ত্র খাতের পিই রেশিও ৪০ দশমিক ৮০ পয়েন্ট, বিবিধ খাতের ৩১ দশমিক ৮১ পয়েন্ট, এভাবে বহু আলোচিত দাপুটে বিমা খাত থেকে শুরু করে সেবা ও আবাসন খাত, সিমেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, পেপার, ভ্রমণ ও অবকাশ, আর্থিক ও চামড়া খাতের পিই রেশিও প্রায় ২১ থেকে ২৯৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের পিই রেশিও ৭ দশমিক ৬১ পয়েন্ট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ১২ দশমিক ২৯, টেলিযোগাযোগ খাতের প্রায় ১৪ ও ঔষধ ও রসায়ন খাতের পিই রেশিও ২০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এখন বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা কোন খাতে বিনিয়োগ করবে।
সামগ্রিক বাজারের পিই রেশিও দেখে ঢালাওভাবে বাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট খাত ও নির্দিষ্ট কোম্পানির পিই দেখতে হবে। পিই রেশিও হলো কোন কোম্পানির শেয়ার কিনে লভ্যাংশের প্রাপ্তির মাধ্যমে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসতে কত বছর লাগবে তা বুঝায়। এক্ষেত্রে কোম্পানির আয় অপরিবর্তনীয় থাকতে হবে। বিনিয়োগকারীদের ভেবে দেখতে হবে তাঁরা কত দ্রুত বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পেতে চান। অর্থাৎ পিই রেশিও যত কম হবে ততোই ভালো। সাধারণত পিই রেশিও ১৪ থেকে ১৮-এর মধ্যে থাকা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা নিরাপদ ধরা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পিই রেশিও বেশি হতে পারে, যদি নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার মাত্রা বেড়ে যায়। উল্লেখ্য, আমাদের শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পিই ছিল প্রায় ৩০ পয়েন্ট। ফলে পরের দৃশ্য তো সবারই জানা। আবার অনেকে বলেন, আমাদের জিডিপির আকার যেভাবে বড় হচ্ছে শেয়ারবাজার সেভাবে বড় হতে পারেনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় শেয়ারবাজার অনেক ছোট, যা এখন জিডিপির ১৮-১৯ শতাংশ। এক বছর আগেও ছিল ১১-১২ শতাংশ। তাই শেয়ারবাজার এখনো বাড়ার অনেক সুযোগ রয়েছে।
আমাদের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা, ডিবেঞ্চার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, বন্ড ইত্যাদির সরবরাহ অনেক কম। আবার অনেক কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ অনুপযোগী, ভালো শেয়ারের সংখ্যা বেশি নয়। উন্নত বিশ্বের মতো শেয়ারবাজারের আয়তন বাড়াতে হলে ভালো শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড অর্থাৎ বিনিয়োগযোগ্য পণ্য বাড়াতে হবে এবং প্রশিক্ষিত এক বিনিয়োগ গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। এটা সবারই জানা, একেক দেশের ব্যবসায়িক অবস্থা, অর্থনৈতিক স্তর, অবকাঠামো, নিয়মনীতি একেক রকম। মানুষের-ব্যবসায়ীদের তথা বিনিয়োগকারীদের আচরণ, চরিত্র, জ্ঞানও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অথচ আমরা তুলনার বেলায় সবাইকে একভাবে চিন্তা করি। বর্তমান কমিশনের বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপ ও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্বে যেমন পরিচালক, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকার হাউসকে জরিমানা করায় কমিশনের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও কঠোর থাকবে বিএসইসি। এতে ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী।স্মরণ করা যেতে পারে, টানা মন্দায় ২০২০ সালের শুরুতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বিশেষ তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু মহামারীর শুরুতে শেয়ারবাজার যখন ধসের সম্মুখীন হয়, তখন কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। দু-একটি ব্যাংক ছাড়া কেউ বিনিয়োগে যায়নি।
তবে এই মহামারীতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণের তেমন চাহিদা নেই। সিআরআর সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে রয়েছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে টাকা নিয়ে বসে নেই ব্যাংক। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজার এবং বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা যাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ব্যাংকগুলোকে দৈনিক ভিত্তিতে তহবিল ব্যবহারের তথ্য জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জবাবে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন না নিয়ে মাসিক ভিত্তিতে নেওয়ার প্রস্তাব জানিয়েছে, যা এক প্রকার তামাশার শামিল। আগে এ তথ্য পাক্ষিক ভিত্তিতে নেওয়া হতো। শেয়ারবাজার খুবই সংবেদনশীল ও গতিশীল একটি জায়গা। সল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক বড় কিছু ঘটে যেতে পারে।
আমাদের সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূল কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে দেশের আর্থিক খাত। এখানে শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন আশা করা যায় না। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা না থাকলে সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। এটি নিশ্চিত শেয়ারবাজারে এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে শেয়ারবাজার যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তা ধরে রাখাই হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ। অন্যথায় ২০১০ সালের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়হীনতা, আইন পরিপালনে ব্যর্থতা অথবা বিনিয়োগকারীদের অধিক আস্থার কারণে ঘুরেফিরে ২০১০ সালের ধসের যে পুনরাবৃত্তি হবে না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পাশাপাশি বিগত ১০ বছরের ফিরে পাওয়া আস্থা অনাস্থায় পরিণত হতে সময় নেবে না। একটি সুষ্ঠু স্বাভাবিক শেয়ারবাজার সবারই কাম্য।
বিনিয়োগকারীদের সামগ্রিক শেয়ারবাজারের ওপর আস্থার চেয়ে বিনিয়োগকৃত কোম্পানির ওপর আস্থা খুঁজে পাওয়া জরুরি। শেয়ারের দর হুহু করে বাড়তে দেখে, মৌলভিত্তি বিশ্লেষণ না করে, নিজের সক্ষমতা না বুঝে ও গুণগত বিনিয়োগ না করলে লাভ পাওয়া তো দূরের কথা, আসল নিয়ে টানাটানি শুরু হতে পারে। ব্যাংকের সুদহার কম, করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা তাই লাভের আশায় শেয়ারবাজারে আসছে। মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সবার জন্য নয়। বিনিয়োগের আগে ভালো করে খোঁজ খবর নিতে হবে। ভালো করে জেনেশুনে, আর্থিক জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে, সময় নিয়ে, পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ করতে হবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন