এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর
আমাদের জাতীয় বনের নাম সুন্দরবন। জাতীয় পশু যে বাঘ তারও নিবাস এই সুন্দরবনে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে সুন্দরবন আমাদের কাছে গর্বের ধন। জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে যখন আমরা একের পর এক হারিয়ে ফেলছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এবং নানা জীবজন্তু পাখি ও উদ্ভিদ, সেখানে সুন্দরবন সমুদ্রের কোল ঘেঁষে জীববৈচিত্র্যের সুরম্য নিকেতন হিসেবে অটল দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মা যেমন সকল বিপদ-আপদ নিজের গায়ে টেনে নিয়ে সন্তানকে রক্ষা করে তেমনি ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস পীড়িত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সুরক্ষা দান করে সুন্দরবন। সুন্দরবনের এই আত্মদান আমরা দেখেছি সাম্প্রতিককালের ঝড় সিডর ও আইলাতে।
একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। এক সময়ে অর্থাৎ সত্তরের দশকের পূর্বে এই বনভূমি বাংলাদেশে ছিল শতকরা ১৭ ভাগ। এখন কাগজেকলমে ৯ ভাগ থাকলেও সুন্দরবন ছাড়া বাকি বনভূমির বৃহদাংশই বাস্তবে দখলিকৃত বা গাছপালাশূন্য আকারে।
অতুল সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন বাংলাদেশকে জোগান দেয় কাঠ, গোলপাতা, মধু, মোম, নানা জাতের দুর্লভ প্রাণী এবং মৎস্যরাজি। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এই বনভূমি আকর্ষণ করে পর্যটকদের। অল্প কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেই এটি হতে পারে পর্যটন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কিন্তু শিল্পায়নের ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে আমরা ধ্বংস করে ফেলছি এই সুন্দরবন। শিল্পের জাতীয়করণের নামে আমরা ১৯৭২ সালে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম পাট, বস্ত্রসহ বাংলাদেশের প্রায় সব শিল্পকে, দেশকে পরিণত করেছিলাম শীর্ষ দরিদ্র রাষ্ট্রে। সম্পদ বাড়ানোর নাম দিয়ে সম্পদকে ধ্বংস করার সেই নীতি এখন প্রয়োগ হচ্ছে সুন্দরবনে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হলো এই সুন্দরবন বিনাশি প্রচেষ্টার অন্যতম উদাহরণ। এখান থেকে নাকি উৎপাদন করা হবে বছরে এক হাজার তিনশ বিশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কয়লাচালিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আসবে সম্ভবত ভারত থেকে। এই কয়লা আনয়নে এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালনার ফলে পরিবেশের যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তাতে করে সুন্দরবন এবং তথাকার প্রাণীকূলের টিকে থাকাটা হয়ে পড়বে সত্যিই দুষ্কর। কারণ কয়লা পরিবহনের সময় জাহাজ থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য কম-বেশি সুন্দরবনে পড়বে।
কয়লা ও বাতাসের ঘর্ষণে আগুনও ধরে যেতে পারে যখন তখন। জাহাজের শব্দ, ধোঁয়া, আলো, প্রভৃতি সুন্দরবনের প্রাণীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। রামপালে কয়লা এনে তা যখন জাহাজ থেকে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে, তখন কয়লার প্রচ- ধূলো ও বিষাক্ত পদার্থ চারপাশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। গত দুই বছরে সুন্দরবনের নদ-নদীগুলোতে ৫/৬টি তেল, কয়লা ও সিমেন্টবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে আরও বেশি বেশি কয়লার জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটতে পারে। বলা হচ্ছে, ধূলা নির্গমণ কম হয় এমন জাতের কয়লা এবং শব্দ কম করে এমন ধরনের জাহাজ ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এতে ব্যয় এত বেশি বেড়ে যেতে পারে যে, তাতে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে রামপাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে। এ ছাড়া এমন প্রতিশ্রুতি যে পালিত হবে তার কি নিশ্চয়তা আছে? ভারতকে করিডোর দেওয়ার চুক্তি করার সময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ করিডোরের মাধ্যমে ভারত থেকে বছরে ৭০০০ কোটি টাকা আয় করবে। অথচ চুক্তির ঝামেলা শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী জানান যে, করিডোরের উপরে কর (ট্যাক্স) নেওয়াটা লজ্জার বিষয়।
রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে স্বয়ং ইউনেস্কো। ইউনেস্কো স্পষ্টতই উল্লেখ করেছে যে, রামপাল পাওয়ার প্লান্ট সুন্দরবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ইউনেস্কোর কথায় কান দিচ্ছে না। তারা সুন্দরবন রক্ষার জন্য জনগণের সোচ্চার হওয়াকেও অপব্যাখ্যা করছে। সুন্দরবন রক্ষা ও রামপাল প্রকল্প বাতিলের জন্য যারা সোচ্চার হচ্ছেন তাদেরকেও পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মী লেলিয়ে দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় মনে হচ্ছে সুন্দরবন অচিরেই বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়বে। সুন্দরবেনর বিপন্ন প্রাণী বাঘ ও ডলফিন অচিরেই হয়তো চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। রামপাল প্রকল্প ছাড়াও সুন্দরবন এলাকায় আরও কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা হচ্ছে, যেগুলো সুন্দরবনকে আরও বেশি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। সুন্দরবনের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করার জন্যই বুঝি সুন্দরবনের নিকটবর্তী পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ১৫০ এর অধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে সরকার অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। এ ছাড়াও ৩০০টি শিল্পগোষ্ঠী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সুন্দরবনের পাশের গ্রামগুলোতে প্রায় ১০ হাজার একর জমি ক্রয় করেছে।
ইউনেস্কোর রিপোর্টে জানা গেছে, ফারাক্কা বাঁধের জন্য সুন্দরবন ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের গাছপালা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং গাছপালাগুলো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানি উজান থেকে ভারত প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। তাই সুন্দরবন রক্ষার জন্য শুধু রামপালের প্রকল্প বাতিলের আন্দোলন করলেই চলবে না, ফারাক্কা বাঁধ অপসারণের আন্দোলনও শুরু করে দিতে হবে। ভারতের বিহার প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে নেওয়ার জন্য দাবিনামা পেশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও ফারাক্কা বাঁধ প্রত্যাহারের দাবি জোরেশোরে তুলতে হবে।
সুন্দরবন রক্ষা করা বাংলাদেশকে রক্ষারই নামান্তর। কেননা সুন্দরবন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের আবহাওয়ার আর্দ্রতা রক্ষা করে, কুয়াশা হ্রাস করে এবং বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশের আয়তন ১৭৭৬ সালে ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটার। কয়েক বছর আগে সুন্দরবনে বাঘ ছিল সাড়ে চারশর মতো, এখন আছে মাত্র সোয়াশ। সুন্দরবনকে আর কোনোমতেই নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সুন্দরবন এলাকা থেকে সকল ধরনের সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প সরিয়ে ফেলতে হবে। সুন্দরবন থেকে বেদখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা সব চর ও দ্বীপে বনায়ন করে সুন্দরবনকে সম্প্রসারিত করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন