শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটি কখনো সরলরেখায় চলে না। কিছুদিন পর পর শেয়ারদরের মূল্য সংশোধন হওয়া সুষ্ঠু-স্বাভাবিক বাজারের লক্ষণ। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির সুসময় তো শেয়ারবাজারের সুসময় এমনটাই বলে থাকে বাজারসংশ্লিষ্টরা, সর্বোপরি একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিফলন শেয়ারবাজারে দেখতে পাওয়া যায়। বিগত কিছু মাস ধরে শেয়ারবাজারে টানা তেজিভাবই প্রমাণ করে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অথচ, এক যুগ ধরে সব অর্জন উন্নয়নের সাফল্যকে ম্লান করেছে শেয়ারবাজার। যেখানে অনিয়মই অলিখিত নিয়ম আবার নিয়মের মধ্যেও এটি এক অনৈতিকতার নির্বিঘ্ন বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেখান থেকে পরিত্রাণে দরকার দেশের আর্থিক খাত তথা শেয়ারবাজারে নৈতিকতার বিপ্লব। নতুন কমিশনের হাত ধরে শেয়ারবাজার সে দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। শেয়ারবাজার নিয়ে ১০-১৫ বছর আগের তুলনায় সরকারের মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কাঠামোগত অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহু কাক্সিক্ষত সুশাসন। তাই সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী এখন বাজারমুখী। ফলে তর তর করে এগিয়ে চলছে সূচক। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথা থেকে আসছে এতো বিনিয়োগ। ধারণা করা হচ্ছে ছোট, বড়, মাঝারি সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই আগ্রাসী বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে-ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের প্রাধান্য বেশি। তারা খুব সহজেই আতঙ্কিত বা আশাবাদী হন। তাই বিনিয়োগে প্রাতিষ্ঠানিক অংশ বাড়ানোর উদ্যোগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে আইনি ছাড় দিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিশেষ তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরবর্তিতে বাজারে এ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ও পণ্য বৈচিত্র্য আনতে এ বছরের জানুয়ারিতে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে যেসব ব্যাংকে বন্ড অনুমোদন করা হয়েছে, সেসব বন্ডকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করাসহ শেয়ারবাজারে ব্যাংকের ওই বিশেষ তহবিলের ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এই বিশেষ তহবিল ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখা হয়েছে। এ জন্য কোন খাতের শেয়ারে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে এবং কতটুকু করা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি একটি নীতিমালা করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। জানা গেছে, তহবিলের এ অর্থ বিনিয়োগে কোনো কোনো ব্যাংক নিয়মনীতি পরিপালন না করে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিসহ আজেবাজে, দুর্বল, মানহীন শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। তহবিল ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাংকগুলো তিন মাস পর পর বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবেদন জমা দিত। ওই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এ কারণে তহবিলের অর্থ ব্যবহারে তদারকি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সময়সীমা কমিয়ে প্রতি তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার টানা উত্থানে প্রণোদনা ঋণসহ বিভিন্ন ঋণের অর্থ শেয়ারবাজারে ঢুকছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্টমহলের সব সূত্র থেকে। তাই ঋণের এ অপব্যবহার রোধে স্থানীয় মুদ্রা-বাজারে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। গত ১২ আগস্ট সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে দৈনিক লেনদেনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি আইন লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করায় একটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে বিশেষ তহবিলের অপব্যবহার করায় ১২টি ব্যাংককে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বলতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১০ সালেও ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগই ছিল শেয়ারবাজার ধসের মূল কারণ। ব্যাংকের বিনিয়োগে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হবে। অনেক কিছু নিয়মে থাকলেও নীতি নিয়ে ভাবতে হয়। বাংলাদেশের মতো ছোট শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বা বড় শ্রেণির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতিবহির্ভূত বিনিয়োগই সুষ্ঠু বাজার গঠনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। যেখানে এ জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নির্মোহভাবে ফাইন-টিউনিংয়ের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখবে, সেখানে তাদের বিনিয়োগই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন এবং সামগ্রিক বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ বাজার বিশেষজ্ঞরা। এ যেন বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার মতো অবস্থা। তাই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ও মিউচুয়াল ফান্ডকে শক্তিশালী করে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
অন্যদিকে একশ্রেণির মৌসুমি বিনিয়োগকারী আছেন যারা বাজার ঊর্ধ্বমুখী শুনে অন্যের কথায় নতুন বিনিয়োগে আসেন। তারা যেন এই বুলিশ মার্কেটে কোনোরকম বিনিয়োগ করতে পারলেই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেন। অথচ, সব সময় যে শেয়ারবাজার বিনিয়োগযোগ্য থাকে না, সেই মাত্রাজ্ঞানটুকু তাদের নেই। ব্রোকারেজ হাউসের বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০৯-১০ সালের মতো নানা শ্রেণির মানুষ মুনাফার লোভে প্রতিদিনই বাজারে আসছেন। নতুন নতুন গ্রাহক বিও একাউন্ট খুলছেন। একাউন্ট খুলেই সরাসরি দেখা করে বা ফোন করে আইটেম (দ্রুত দাম বাড়ে এমন শেয়ারের নাম) চাচ্ছেন। কোনো শেয়ারের নামই জানেন না, এমন ব্যক্তি ১৫-২০ লাখ টাকা জমা করে শেয়ার কেনার জন্য বলছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, এমন শেয়ার কিনছেন, যার হয়তো ‘চাল-চুলোই’ নেই। তাদের অনেকেরই শেয়ারবাজার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। নানাজনের কাছ থেকে শুনে এমন শেয়ার কিনছেন, যার বেশিরভাগই রুগ্ণ এবং কারসাজি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাজার-সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান শেয়ারবাজার চলছে গুজবের ওপর ভর করে। সবাই ‘আইটেম’ চাচ্ছে। প্রথমে পুরো বাজার ছিলো বীমা খাতের শেয়ারকেন্দ্রিক। ওই সময় রাতারাতি এ খাতের অনেক শেয়ার ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়ে। এর পর মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের দর প্রায় একইভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি বৃহৎ মূলধনি গুটিকয় কোম্পানিনির্ভর হয়ে পড়েছে লেনদেন। এসব শেয়ারের মধ্যেও কয়েকটির দর বেড়ে তিন থেকে আটগুণ হয়েছে। পরবর্তিতে বস্ত্র খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। এভাবে স্বল্প মূলধনি দুর্বল খাতভিত্তিক লেনদেন মোটেও সুষ্ঠু বাজারের লক্ষণ নয় এবং স্পষ্টত-ই যে কারসাজির অংশ, তা বলা বাহুল্য।
সামগ্রিক বাজার বিবেচনায় গত বছরের জুলাই থেকে বাজার নতুন করে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসে এবং টানা এই ১৪ মাস ধরে তা অব্যাহত রয়েছে। যদিও এর মধ্যে এ বছরের প্রথমার্ধে সূচক একই বৃত্তে (সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার) ঘুরপাক খায়। দ্বিতীয়ার্ধে (জুলাই-আগস্ট) টানা সূচক বেড়ে সেপ্টেম্বরে ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে। এ সময়ে তালিকাভুক্ত ৩৪৫ কোম্পানির শেয়ারের ৫৪ শতাংশ বা ১৮৬ টির দর দ্বিগুণ থেকে ১১ গুণ হয়েছে। কমপক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের দর বেড়েছে ৮২ শতাংশ। গত আড়াই মাসে সূচক বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ পয়েন্ট। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালে ধসের আগের দুই মাস (অক্টোবর, নভেম্বর) সূচক বাড়ে ১ হাজার ৩৭৯ পয়েন্ট। ২০০৯ সালে এশিয়ার প্রথম সারির হাই পারফরম্যান্স ৫টি স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে ডিএসই একটি। বর্তমানেও ডিএসই বিশ্বসেরা স্টক এক্সচেঞ্জ পারফরমারদের তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে। তবে ২০১০ সালের চেয়ে বাজার এখন অনেক বেশি সুগঠিত। ভেবে দেখা দরকার, শুধু সুশাসনই কি বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের সুরক্ষা দেবে যদি বিনিয়োগকারী পরিকল্পনামাফিক যৌক্তিক বিনিয়োগ না করেন। বিনিয়োগকারীদের ভুল বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার শত সফলতাকেও ম্লান করে দেয়।
শেয়ারবাজারের টানা উত্থানের সুযোগে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বেশকিছু দুর্বল শেয়ারে যেখানে বিনিয়োগ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং বারবার সচেতন করে তথ্য প্রকাশ করছে। কিন্তু লেনদেনে দেখা যাচ্ছে, ঘুরেফিরে এ কোম্পানিগুলোই শীর্ষে থাকে। বাঙালির চরিত্র উম্মোচনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না’ তেমনি বাঙালি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে বলতে হয়, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে বিশ্লেষণ করেন না, লাভ পেতে চান ধৈর্য্য ধরেন না। বিনিয়োগকে পেশা হিসেবে নিতে চান কিন্তু বিনিয়োগ শিক্ষা বা আদর্শ গ্রহণ করেন না। তারা আবেগে, গুজবে, ঔদাসীন্যভাবে বিনিয়োগ করেন। ফলে লসের ভারে বৃথা আস্ফালন করেন, বাস্তবতা বোঝেন না। এতো ‘না’ এর সম্ভাব্য পরিণতি যে আদৌ সুখকর হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন