নানার হাত ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় পা পিছলে হঠাৎ নালায় শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন নানা হাজী জামাল এবং মামা জাকির হোসেন। কিন্তু মুহূর্তেই স্রোতের টানে হারিয়ে যান সাদিয়া। টানা পাঁচ ঘণ্টা তল্লাশির পর মূল সড়ক থেকে ৭০ ফুট গভীরে নালার আবর্জনার ভেতর থেকে সাদিয়ার নিথর দেহ বের করে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সোমবার রাত ১০টায় হালকা বৃষ্টির সময় চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের বাদামতল মাজার গেইট এলাকার নর্দমায় ঘটে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা।
রাত ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করার পর পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। ওই এলাকায় সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তা, ফুটপাত, নালা ভেঙে একাকার। সø্যাব ছাড়া উম্মুক্ত নালা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। সেই ফাঁদে পড়ে মুহূর্তে প্রাণ হারালো মেধাবী শিক্ষার্থী সাদিয়া। উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত এবং সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির ফলে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের অসংখ্য ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে। এসব ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছোটবড় দুর্ঘটনা।
একের পর এক ঘটনা ঘটলেও নেই কোন প্রতিকার। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ একে অপরকে দোষারোপ করেই দায় সারছে। এর আগে, গত ২৫ আগস্ট নগরীর ষোলশহরের চশমা খাল সংলগ্ন উম্মুক্ত নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমদ। এখনো তার হদিস মেলেনি। নালায় পড়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তার সহকর্মী ও স্বজনেরা। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দুর্ঘটনাস্থলে তার সহপাঠীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন সাদিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। এর দায় সিটি কর্পোরেশন এবং সিডিএকে নিতে হবে। তারা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তার আগে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।
নিহত শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া নগরীর বড়পোলের বাসিন্দা প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর কন্যা। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সাদিয়া সবার বড়। মামা এবং নানার সাথে সোমবার রাতে বাদামতল জেক্স মার্কেট এলাকায় চশমা কিনতে যান সাদিয়া। চশমা কিনে মাজার গেইট এলাকার ফুটপাত ধরে আগ্রাবাদ মোড়ের দিকে যেতেই হাতের বাম পাশে সø্যাববিহীন উম্মুক্ত নালায় পড়ে যান সাদিয়া। হালকা বৃষ্টি হওয়ায় নালায় তখন স্রোত ছিল। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিসহ একটি উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। ডুবুরি টিম প্রথমে নালায় নেমে তল্লাশি করে। এরপর ক্রেন দিয়ে আবর্জনা অপসারণ শুরু হয়। একপর্যায়ে সিটি কর্পোরেশনের আরেকটি ক্রেনও উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় তরুণরাও আবর্জনা অপসারণে যোগ দেন। রাত ২টা ৫৫ মিনিটে সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ফুটপাত ঘেঁষে সড়কের নিচে বড় নালা। কিন্তু নালার ওপর কোনো সø্যাব ছিল না। চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের কারণে ওই সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে পানি জমে নালার আকার ধারণ করেছে। সø্যাব না থাকায় বোঝার কোনো উপায় নেই যে, নালা নাকি গর্ত। নালার ওই অংশে কমপক্ষে সেখানে তিন টন আবর্জনা জমে আছে। অনেক চেষ্টা করেও ডুবুরি সেখানে যেতে পারেনি। সেই নালার সø্যাব উঠিয়ে এক টনের মতো আবর্জনা-মাটি অপসারণ করা হয়। তখন মূল সড়কের ৭০ ফুট গভীর থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার পর গতকাল উম্মুক্ত নালার ওই অংশে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করে দেয়া হয়। এর আগেও নগরীতে উম্মুক্ত নালায় পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গত ৩০ জুন নগরীর মুরাদপুরে বৃষ্টির সময় অটোরিকশা নালায় পড়ে তলিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে দুইজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৯ জুন চান্দগাঁও বি-ব্লকে উম্মুক্ত নালায় অটোরিকশা পড়ে গুরুতর আহত হন তিন মহিলা।
এভাবে মহানগরীর নালা-নর্দমা ও সড়কপাশের খালগুলো মৃত্যুফাঁদে রূপ নিয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় মহানগরী। পানিতে একাকার হয়ে যায় সড়ক-নালা-নর্দমা ও ছোট ছোট খাল। এসব খাল-নালায় রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান উল্টে মানুষ হতাহত হচ্ছে। নগরীর প্রধান সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত অংশসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ব্যাপক খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। নালা-নর্দমা ভেঙে এসব এলাকায় বড় বড় ডোবার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগ বা প্রতিকারের ব্যবস্থা দেখা যায় না।
নগরীর চশমা খালে সবজি বিক্রেতা তলিয়ে যাওয়ার পর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে উম্মুক্ত নালায় সø্যাব বসানোর ঘোষণা দেয়া হলেও নগরীর কোথাও ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি। আগ্রাবাদের দুর্ঘটনার পর সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী এজন্য সরাসরি সিডিএকে দায়ী করেন। মেয়র বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে সিডিএ’র অবহেলা ও অসতর্কতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাস্তায় গর্ত হয়েছে। ফুটপাতের ওপর কাদা জমেছে। বৃষ্টির পর সেই কাদা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। কাদার ওপর পা পড়ার পর পিছলে মেয়েটি নালায় পড়ে গেছে। পানিতে রাস্তা এবং নালা এক হয়ে গেছে, মানুষ বুঝবে কিভাবে?
ফুটপাতে সø্যাব ও রেলিং দেওয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের- স্মরণ করিয়ে দিলে মেয়র বলেন, দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে কাজ চলছে, এগুলো সিটি কর্পোরেশনের আওতায় নেই এখন। এটার মেইনট্যানেন্স থেকে শুরু করে সমস্তকিছু সিডিএর দায়িত্ব। মেয়রের বক্তব্য প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেস প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ওই নালায় কখনো সø্যাব ছিল না। বরং আমরাই নালার কিছু অংশে সø্যাব তুলে দিয়েছি। দুর্ঘটনার জন্য কোনভাবেই সিডিএ দায়ী নয় দাবি করে তিনি বলেন, এর দায় সিটি কর্পোরেশনের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন