শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাজধানীর অনুমোদনহীন ভবন যেন মৃত্যুফাঁদ

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

রাজধানী ঢাকায় অবৈধভাবে (নকশা ও রাজউক অনুমোদন বিহীন) প্রচুর ভবন গড়ে উঠছে। এসব ভবন এক একটি মৃত্যু ফাঁদ। বিভিন্ন সময়ে এসব ভবন ধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন।

হঠাৎ করেই বহুতল ভবন ধসে পড়ে, কাত হয়ে যায়, নিকট অতীতে খোদ রাজধানীতেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। পরে রাজউক এসে বলে, ভবনটির অনুমোদন ছিল না। প্রচুর মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন হাউজিং কম্পানি বা আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ‘আবাসিক প্লট’ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। বড় অভিযোগ হলে রাজউক বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না। ‘অনুমোদন নেই’ বলে দায় এড়িয়ে যায়।

খুলনায় ১০৮টি আবাসন প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ১০টি বৈধ, বাকি ৯৮টি অবৈধ। অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোও দিব্যি প্লট ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা সেসব আবাসন এলাকায় রাস্তা, খালি জায়গা রাখা বা অন্যান্য নিয়মের প্রায় কিছুই মানা হচ্ছে না। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) মাঝেমধ্যে সাইনবোর্ড ভেঙে দেওয়া ছাড়া প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।

দেশে মানুষ বাড়ছে। ঘরবাড়ির চাহিদা বাড়ছে। আবাসন এলাকার লোভনীয় বিজ্ঞাপন বা সুযোগ-সুবিধার কথা শুনে সাধারণ মানুষ নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে একখন্ড জমি বা ফ্ল্যাট কেনে। ঘরবাড়িও তৈরি করে। কিন্তু নিয়মনীতি না মেনে বা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব আবাসন এলাকাকে কেডিএ কি অনুমোদন দেবে? অনুমোদন না দিলে যাঁরা প্লট কিনছেন তাঁরা সেখানে বাড়ি তৈরি করবেন কীভাবে? আবার কৃষিজমিতেও অনুমোদনহীন অনেক আবাসন এলাকা গড়ে উঠেছে। দিনে দিনে সেই জমির চরিত্র বদল হচ্ছে। সেসব জমিতেও বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এমন ঘটনা শুধু খুলনায় নয়, সারা দেশেই ঘটছে। এসব মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব কি প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নেবে না? প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, খুলনা শহরের সিটি বাইপাস সড়ক অথবা খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের দুই পাশে বহু আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড কেন প্রশাসনের চোখে পড়ে না?

অনুমোদন ছাড়াই ঢাকায় নির্মিত হচ্ছে শত শত বহুতলবিশিষ্ট ভবন। নিয়ম না মানায় ভবনগুলো একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে এগুলো নিয়ে বিরোধ লেগেই আছে। নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত ইমারত (ভবন) নির্মাণে আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ১৯৫২ সালে প্রণীত আইনের আওতায় তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। অথচ, ৫ যুগ পরেও আইনটি বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ বা সমন্বিত কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এতে করে সারা দেশেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ প্রবণতা বেড়েই চলেছে।

সূত্রমতে, ঢাকা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতাধীন এলাকায় প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার ভবন নির্মাণের নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বাইরেও প্রতি বছর শত শত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কোনো প্রকার নকশা অনুমোদন ছাড়াই। অনুমোদনবিহীন এসব ভবন একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি বিরোধপূর্ণ। নিয়ম না মানার কারণে ভবনের মালিকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো জায়গা না ছেড়েই ভবন নির্মাণ করছেন। কেউবা রাস্তার জায়গা বা অপরের জায়গার উপর ভবন নির্মাণ করছেন। এসব কারণে বিরোধ লেগেই আছে। বিরোধপূর্ণ এ ধরনের ভবন নিয়ে রাজউকে প্রতিদিনই লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে। রাজউক এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজউকের নোটিশের পরেও ভবন নির্মাণের কাজ থেমে নেই, বরং দ্রæত গতিতে চলছে ভবন নির্মাণের কাজ।

এমন অনেক ভবন এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হলেও এ বিষয়ে প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। ভবনধসে মানুষ মারা যাওয়ার পর কয়েক দিন একটু তদারকি করলেও মাস না যেতেই তা আবার শিথিল হয়ে যায়। আমরা চাই অনুমোদনহীন আবাসন ব্যবসা এবং মানুষের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। শুধু সাইনবোর্ড ভেঙে দায়িত্ব শেষ করলেই হবে না, প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। এছাড়া ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিপূর্বে অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া যানজট, যানবাহন এবং কলকারখানার কালো ধোঁয়া, খাদ্যে ভেজাল, সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যূজ্ব এই শহরে নেই পয়ঃনিষ্কাষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি-ঘোড়া। কিন্তু সে তুলনায় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল স্কুল-কলেজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি নাগরিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুতেই পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। অথচ, রাজধানী ঢাকাই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাÐের প্রাণকেন্দ্র। এজন্য পরিকল্পিত নগরায়ণের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন