কুমিল্লা ময়নামতিতে ৬ তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিক শরীফ হোসেন (২৫) গুরুত্বর আহত হয়ে গত বুধবার থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কর্তব্যরত ডাক্তার জানিয়েছেন শরীফের মাঝা ও ডান পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে। এইবারের মতো প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ডান পা চিরতরে কেটে ফেলতে হবে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। গত ২৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়ে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের তিনতলা ছাদের একাংশ ধসে পড়ে নির্মাণ শ্রমিক রেজা আহমেদ (১৯) মারা যান। এ ঘটনায় আরো ৬ জন আহত হয়।
নির্মাণাধীন বহুতল ভবন থেকে পড়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অহরহ। অথচ ‘সেফটি ফাস্ট’-সবার আগে নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তার বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে না কোথাও। নির্মাণকালে নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা বাড়ছে। কুমিল্লা মহানগরীতে কোনো ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে একের পর এক বহুতল ভবন। ফলে এরকম শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। হতদরিদ্র এসব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা দেয়ারও কেউ নেই। কর্মকালীন সময়ে একজন শ্রমিকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, সে বিষয়ে জাতীয় বিল্ডিং কোডে বিস্তারিত বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকছে। বিষয়টি তদারক করার দায়িত্ব যাদের তারাও উদাসীন। কুমিল্লা মহানগরীতে অসংখ্য সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে। নগর স¤প্রসারিত হচ্ছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। সরকারি উন্নয়ন কর্মকাÐেও নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন শ্রমিকরা। পুরাতন ভবন ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও নেয়া হচ্ছে না যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কুমিল্লা নগরীতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কতজন নির্মাণ শ্রমিক মারা গেছেন তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। কুমিল্লার ব্যবসায়ীক প্রাণকেন্দ্র কান্দিপাড়ের সাথেই বাদুরতলায় সমতট হোল্ডিংস লিমিটেডের বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। অথচ ভবনটির নিমার্ণ কাজ শেষ না হতেই ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে স্বপ্ন নামের একটি সুপারসপ ভাড়া দেওয়ায় প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক কেনাকাটা করতে আসেন নির্মাণাধীন ভবনটিতে।
এছাড়াও ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি বেসরকারি ব্যাংকও রয়েছেন। ভবনটি নির্মাণাধীন হওয়ায় সব সময় মাথার ওপর ঝুঁকি নিয়ে ভবনটিতে হাজার হাজার লোক আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। এছাড়াও নির্মাণনাধীন ভবনের সামনে দিয়ে প্রতিদিন শতশত ছাত্রছাত্রী স্কুলে আসা যাওয়া করছে ঝুঁকি নিয়ে। গত বুধবার সমতট হোল্ডিংস লিমিটেডের ভবনের নির্মাণ কাজ করার সময় হঠাৎ উপর থেকে একটি ইট ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়িতে পড়ে। তবে ওই সময় গাড়িতে কেউ না থাকায় কোন দুর্ঘটনার ঘটনা না ঘটলেও এই ঘটনায় চলাচলে সবার মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এসড়কে কিউ আর টাওয়ার নামে আরেকটি বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে সে ভবনটিতেও একই অবস্থা দেশি বিদেশি মিলে প্রায় ১৫টি বিভিন্ন ব্রান্ডের সুপার শপ রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে এই ভবনটিতেও প্রতিদিন শতশত লোক কেনাকাটা করতে আসছে। এ বিষয়ে সমতট হোল্ডিংস লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মামুনুর রশিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা কাউকে ভাড়া দেইনি। নির্মাণাধীন ভবনের অংশবিশেষ ক্রেতাপক্ষ এবং ল্যান্ডওনারকে বুঝিয়ে দেয়ার পর তারা ভাড়া দিয়েছেন। সেফটির বিষয়ে বলেন, অনেক টাকা খরচ করে গাম বুট, হেলমেট, সেফটি বেল্ট কিনে দিয়েছি। কিন্তু কোনো শ্রমিক এসব পড়ে কাজ করতে রাজি হয় না।
এ বিষয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু দৈনিক ইনকিলাবকে বলে, গাড়িতে ইট পড়ার ঘটনায় আমরা সমতট হোল্ডিংস লিমিটেডের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিবো কাজ বন্ধ রাখার জন্য। নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কোন কাজ করতে পারবে না। এক হিসেবে দেখা গেছে, গত একযুগে কুমিল্লায় নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা পড়ে ৬শ’ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় আসলেও আহত কিংবা পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জরুরি বিভাগে প্রতিনিয়তই হতাহত নির্মাণ শ্রমিকদের আনা হচ্ছে। মৃত্যুর চেয়ে দুর্ঘটনায় পঙ্গু ঘটনা বেশি ঘটছে। মহানগরীর পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও ভবন থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় মাঝেমধ্যে অপমৃত্যুর মামলা হলেও তদন্ত বেশিদূর যায় না। নিরীহ শ্রমিকদের অসহায় পরিবারকে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেন ঠিকাদার এবং ভবন মালিকরা।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, নগরীতে যেসসব স্থানে নিরপত্তা বেষ্টনী ছাড়া বহতল ভবন নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে জেলা প্রশাসন অচিরেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন