রাজধানীর অলিগলিসহ প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ির ফলে নাজেহাল অবস্থা নগরবাসীর। তেজগাঁও, মতিঝিল, বংশাল, ফকিরাপুল, এলিফেন্ট রোড, আগাসাদেক লেন, ফুলবাড়িয়াসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। কিন্তু ঢাকা শহরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও জনদুর্ভোগ লাঘবে দুই বছর আগে ‘সড়ক খনন নীতিমালা’ প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই নীতিমালায় বলা হয়, বর্ষা মৌসুম হওয়ায় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি পরিহার করতে হবে। তবে এ নীতিমালার তোয়াক্কা করছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বর্তমানে দুই সিটির অধীনে অন্তত অর্ধশত সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে প্রায় সব এলাকাতেই সড়কে নেমে নাজেহাল হতে হচ্ছে নাগরিকদের। যদিও সিটি করপোরেশন বলছে এ সংখ্যা সামান্য।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সড়ক খননের সমস্যা কমিয়ে আনতে ২০০৩ সালে ঢাকার সড়ক খনন নিয়ন্ত্রণ ও পুনঃনির্মাণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে এই নীতিমালার কমই মানা হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হওয়ার পর এই নীতিমালার অনুসরণ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে জনদুর্ভোগ লাঘবে পরিকল্পিত এবং উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সড়ক খননের কাজ বাস্তবায়ন, নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন, খনন করা সড়কের পুনঃনির্মাণসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তখন আগের সড়ক খনন নীতিমালা-২০০৩ পরিবর্তন করে সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯ প্রণয়ন করা হয়।
এই নীতিমালায় বর্ষা মৌসুমের মে, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর-এই পাঁচ মাসের মধ্যে রাস্তার খনন কাজ পরিহার করতে বলা হয়। জরুরি প্রয়োজনে বর্ষা মৌসুমে কোনো সড়ক খননের দরকার হলে খননকারী সংস্থাকে মূল ক্ষতিপূরণসহ ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত ফি জমা জমা দিতেও বলা হয়। এছাড়া নীতিমালায় সার্বিক বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘ওয়ান স্টপ সমন্বয় সেল’ এবং সিটি করপোরেশনের অঞ্চলভিত্তিক কয়েকটি ‘মনিটরিং সেল’ গঠন করার কথা বলা আছে।
২০২০ সালের মে মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরের পানিবদ্ধতা নিরসনে ১০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প নেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এই প্রকল্পের কাজ গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের জুনে, ভরা বর্ষায়। এরপর অন্তত ২৫টি এলাকায় রাস্তা কাটা শুরু করে ডিএসসিসি। এখন ৭০ শতাংশ এলাকার খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হয়েছে। তবে সড়ক পুনঃনির্মাণ শুরু হয়নি। এ কারণে বৃষ্টি হলেই সড়কে জমছে পানি, ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ধোলাইখালের নাসির উদ্দিন সরদার লেন, ওয়ারীর টয়েনবি সার্কুলার রোড, ফকিরাপুল, রাজারবাগ কালীমন্দির ও মুগদা এলাকায় সড়ক খননের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সড়কের যে অংশ কাটা হয়েছে, সে অংশ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা বা যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এতে আশপাশের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার আগাসাদেক লেন এলাকার মূল সড়কটি এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। রিকশা বা প্রাইভেটকার তো দূরের কথা, মানুষও চলাচল করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। দেড় মাস যাবত সড়কটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। মাঝেমাঝে কাজের ঢিলেমি চলে। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হওয়ায় সড়কের জমানো পানিতে ডিম পাড়ছে এডিস মশা। ফলে ওই এলাকার মানুষ সড়ক খোঁড়ার পাশাপাশি এডিস মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।
অথচ সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯ অনুযায়ী অন্য কোনো সংস্থা করপোরেশনের রাস্তা খনন করতে চাইলেও তা বর্ষা মৌসুমের আগে বা পরে করতে হবে। অথচ দক্ষিণ সিটি নিজেই বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। এছাড়া ডিএসসিসির আরও কয়েকটি এলাকায় ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, অতি জরুরি ছাড়া কোনো সড়ক কাটা হচ্ছে না। রাস্তা কাটার আগে ওয়ান স্টপ সেলের সভায় অনুমোদন নেওয়া হচ্ছে। এখন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সড়ক খনন নীতিমালায় বর্ষায় রাস্তা কাটায় বিধিনিষেধ থাকায় যে কেউ চাইলেই রাস্তা কাটার অনুমোদন পাচ্ছে না। আগের তুলনায় এখন ১০ শতাংশের কম রাস্তা কাটা হয়। ভবিষ্যতে আরও কমিয়ে আনা হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত ২২ আগস্ট ওয়ান স্টপ সেলের সভায় ছয়টি অঞ্চলের ২৬টি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির অনুমোদন দিয়েছে। এখন অঞ্চল-১ এ ডেসকো, সামিট কমিউনিকেশন কোম্পানি; অঞ্চল-২ এ ডেসকো, পিজিসিবি, ওয়াসা, সামিট কমিনিউকেশন কোম্পানি, তিতাস গ্যাস কোম্পানি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি; অঞ্চল-৩ এ ডেসকো, বিটিসিএল, ডিপিডিসি, সামিট কমিউনিকেশন কোম্পানি, ফাইবার অ্যাট হোম, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল; অঞ্চল-৪ এ ডেসকো, বিটিসিএল, ওয়াসা, সামিট কমিউনিকেশন কোম্পানি, এম আরটি লাইন-৫; অঞ্চল-৫ এ ডেসকো ডিপিডিসি, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, সামিট কমিউনিকেশন কোম্পানি, এম আরটি লাইন-৫ এবং অঞ্চল-৬ এ ডেসকো সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। সব মিলিয়ে এখন ডিএনসিসি এলাকায় ১৩ কিলোমিটারের বেশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।
ডিএনসিসির প্রকৌশল দফতর সূত্র জানায়, পানিবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসি নিজেও অনেকগুলো রাস্তা কেটেছে। এর মধ্যে তেজগাঁওয়ের অন্তত ২০টি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এর বাইরে ফার্মগেট, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, রামপুরায় রাস্তা কাটা হচ্ছে। অনেক এলাকার কাজ শেষ পর্যায়ে আছে।
সরেজমিনে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় দেখা গেছে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার চারটি প্রধান সড়কের প্রত্যেকটিতে কাটা ও খোঁড়া হয়েছে। যার ফলে এই এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী প্রতিটি মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। সামান্য জায়গা দিয়ে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি ও প্রাইভেটকার পার হতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। খোঁড়াখুঁড়ির ফলে রাস্তাটির চারভাগের দুই ভাগেই বন্ধ হয়ে আছে। আর একটি অংশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে পার হতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে। ফলে ৫ মিনিটের রাস্তা পারাপার হতে সময় লাগছে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা। কারণ, রাস্তার মাঝখানে কাটা হয়েছে। বিপরীত দিক থেকে একটি প্রাইভেটকারও যদি আসে, তাহলে পুরো রাস্তায় যানবাহন আটকা পড়ে থাকছে। এমনকি পেছন থেকে কোনো গাড়ি সজোরে এলে, ধাক্কা খেয়ে রিকশা উল্টে পড়ার মতো অবস্থা। এতে যাত্রীরাও আহত হচ্ছেন। আহত হচ্ছেন রিকশা চালকও।
তেজগাঁওয়ের এই এলাকায় আছে নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট এবং শমরিতা হাসপাতাল। হাসপাতালে বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা যাতায়াত করে থাকেন। তাদেরও পড়তে হচ্ছে বেশ ভোগান্তিতে। ফলে যারা এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছেন, তাদের পাশাপাশি এসব হাসপাতালে করোনার ভ্যাকসিন নিতে আসারাও পড়ছেন ভোগান্তিতে। রাস্তায়ই দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। নির্দিষ্ট সময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারছে না অনেকেই। তাতে বিরক্ত নগরবাসী।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহম্মদ আমিরুল ইসলাম কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির প্রকৌশল দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালা অনুযায়ী সেবা সংস্থাগুলোর সড়ক খননে সিটি করপোরেশনের কাছে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নিজেদের মতো করে বছরের বিভিন্ন সময় সড়ক খননের অনুমতি চাইছে।
তবে অনিবার্য কিছু কাজ ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীতিমালা মানা হচ্ছে এবং আগের তুলনায় সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ কমেছে বলেও দাবি দুই সিটির কর্মকর্তাদের। তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্প, খোঁড়াখুঁড়ি ও জনভোগান্তি রোধে সড়ক খনন নীতিমালা থাকলেও সেটি উপেক্ষিত। ফলে নগরে জনভোগান্তি কিছুতেই কমছে না। এই দুর্ভোগ লাঘবে এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি গ্রুপের সঙ্গে সেবা সংস্থার আলোচনা ও করণীয় নির্ধারণ, সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ, নীতিমালা অনুযায়ী ‘ওয়ান স্টপ’ সমন্বয় সেল এবং সিটি করপোরেশনের অঞ্চলভিত্তিক কয়েকটি ‘মনিটরিং সেল’ কার্যকর করার পরামর্শ তাদের।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ইনকিলাবকে বলেন, সেবা সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় সড়কের নিচে পানি, পয়ঃপ্রণালী, ড্রেনেজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশনসহ জরুরি প্রয়োজনে নগরীর বিভিন্ন সড়ক খনন করে। কিন্তু খনন এবং তৎপরবর্তী মেরামতে সমন্বয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রায়ই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প, খোঁড়াখুঁড়ি ও জনভোগান্তি রোধে সড়ক খনন নীতিমালা উপেক্ষিত।
এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, নীতিমালায় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খননকাজ পরিহার করার কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় নেই। সিটি করপোরেশনের কাছে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দেওয়ার কথা বলা থাকলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। তাই সিটি করপোরেশনকে সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন