শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বদরুলের মায়ের দোয়া কবুল হোক

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

বদরুলের মায়ের কথা, ‘আমি এত কষ্ট করি তারে লেখাপড়া করাইলাম। আমি অভাবি মানুষ। মানুষের কাছ থাকি সায়-সাহায্য লইয়া তারে লেখাপড়া করাইছি। আর হে গিয়া এমন কাম করল, যার লাগি দেশত মুখ দেইতাম ফররাম না। ফরার (পরের) ফুড়িরে (মেয়েকে) ইলা জালিমর রাখাম মারল। আমার ফুয়ায় (ছেলে) জঘন্য অপরাধ করছে। এর লাগি হাসপাতালেও তারে দেখতাম গেছি না।’ আর বদরুলের চাচা চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘এই কুলাঙ্গারের মুখ দেখতাম চাই না।’ এভাবেই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আলোচিত বদরুল আলমের মা ও চাচা। গত ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক বদরুল আলম। কারো নাম ব্যঙ্গাত্বকভাবে ডাকা অন্যায় হলেও বদরুল আলমের সহপাঠীরা নাকি তার কর্মকা-ে অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে তার নামের শেষ অংশ (রুল) বাদ দিয়ে প্রথম অংশ (বদ) বলেই ডাকতো। বদরুল তার ভেতরে পশুত্বের যে দিকটি এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল অবশেষে তাও প্রকাশিত হলো। ফলে বন্ধুদের দেওয়া ‘বদ’ নামেই এখন সে পরিচয় লাভ করেছে।
বদরুলের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু ও শেষ দু’টোই গণধোলাইয়ের মাধ্যমে। জানা যায়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পরে খাদিজার বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা শুরু করে, সেই সময় থেকে সে খাদিজার পিছু নেয়। ২০১২ সালে এক পর্যায়ে খাদিজার এলাকায় গিয়ে তাকে বিরক্ত করলে গণধোলাইয়ের শিকার হন। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি বদরুল। বরং তার সংগঠনের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতেই জামায়াত-শিবির হামলা করেছে বলে অপপ্রচার করেন তখন। এভাবে সে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টায় সফল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় তার চিকিৎসা হয়। কিছু মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে বদরুল প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারি তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা সাহায্য নিতেও সক্ষম হয়। কিন্তু সে এমন একজন ঘাতক হয়ে উঠবে এটা হয়তো কারো জানা ছিল না। তার মাঝে সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও নেই। যাদের বাসায় থেকে-খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করলো তাকেই আবার হত্যা করার চেষ্টা! এটা অমানুষদের পক্ষেই সম্ভব। এতে করে, মানুষের মধ্য থেকে আত্মবিশ্বাস উঠে যাবে। কেউ আর অসহায় ছাত্রদের থাকার জায়গা দেবে না। গৃহ শিক্ষকদের প্রতি আর আস্থা থাকবে না। কোনো ধরনের অপ্রতিকর ঘটনা হতে পারে এমন আশংকা থেকে অনেকেই হয়তো আর লজিং মাস্টার রাখতে চাইবেন না।
খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর ভিডিও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মাঝে এক ধরনের ঘৃণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তার কারণ, খাদিজাকে কোপানোর সময় অনেকে তা স্ব-চোখে দেখেও ইমরান ব্যতীত কেউ এগিয়ে আসেনি। অন্যরাও ইমরানের মতো এগিয়ে আসেত পারতো, কিন্তু আসলো না কেন? প্রত্যক্ষদর্শীরা যদি শুরুতেই এগিয়ে আসতো তাহলে বদরুল পিছু হটতে বাধ্য হতো। আবার এটাও সত্য যে, যিনি মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করেছেন তিনি যদি এই দৃশ্যটি ধারণ না করতেন তাহলে খাদিজার ওপর যে হামলা হয়েছে তা মিডিয়ায় আসতো কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল।
কেননা, ‘হাতটা বদরুলের হলেও চাপাতিটা ক্ষমতার’ বলেই তার র্স্পধা বেড়ে গেছে। বদরুল ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক হওয়ায় দলের পরিচয় দেখিয়ে হত্যা করার মতো সাহস করেছে। সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে মারার মামলার প্রধান আসামি কামরুলসহ সহোদর তিন ভাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট। নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৭ খুনের নেপথ্যে হত্যা মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেন। সম্প্রতি যতগুলো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সাথে হয়তো ছাত্রলীগ, নয়তো যুব লীগ কিংবা অন্য কোনো লীগ নামের কোনো না কোনো সংগঠনের লোকজন জড়িত থাকার কথা বারবার মিডিয়ায় উঠে আসছে।
সরকার সমর্থিত সংগঠনের যে কেউ কোনো ধরনের অন্যায়ের সাথে জড়িত হওয়ার সংবাদ মিডিয়াতে আসলে সাথে সাথেই তারা সাফাই গেয়ে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি আমাদের দলের নয়’। বদরুলের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিশ্বজিৎ হত্যার সাথে জড়িত ৫ ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কেও বলা হয়েছিল তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। আফসানাকে হত্যার পরেও ছাত্রলীগ তেজগাঁও শাখার নেতা রবিন সম্পর্কেও বলা হয়েছিল রবিন এখন আর ছাত্রলীগে নেই, সে বহিষ্কৃত নেতা। তেমনিভাবে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মানিক ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে মিষ্টি বিতরণ করার দিনও ছাত্রলীগ বলেছিল সে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত নয়। অপরাধের আগে এক রকম পরিচয় আর ধরা খেয়ে পালানোর উপায় না থাকলে তখন বলা হচ্ছে অন্য কথা। ক্ষমাতাসীনদলের সাথে যুক্ত হয়ে যে কেউ অন্যায় করতে থাকবে আর তারা কেবল একটি বিবৃতি দিয়ে বলে যাবেন, অমুক আমার দলের কর্মী নয়। একথা বললেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। নিজ দলের কর্মীর সফলতার ভাগিদার আপনি হলে ব্যবর্থতার দায়ভার কেন নিচ্ছেন না?
আমরা জানি, ‘ছাত্রলীগ’ বাংলাদেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি। যারা এখন দেশ পরিচালনা করছেন তারাও তো একসময় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদসহ অনেক সিনিয়র নেতাদের ছাত্রত্বকালে এমন ঘটনার কথা তো শোনা যায় না। কেন্দ্রীয় নেতারা বদরুলদের প্রতি কঠোর না হলে তারাও প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। কিছু অপরাধীর কারণে দিন দিন এ সংগঠনটি বদনামের ভাগী হচ্ছে। যারা প্রকাশ্যে মানুষকে কুপিয়ে মারে, গুলি করে হত্যা, শিশুদেরকে পিটিয়ে মারে, নারী নির্যাতন করে, কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সাথে জড়িত তাদেরকে ছাত্রলীগের এত প্রয়োজন কেন? ছাত্রলীগ কি তাদের ছাড়তে পারছে না, নাকি তারা ছাত্রলীগ ছাড়ছে না?
শোনা যাচ্ছে, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হবে। আর এতে করে অপরাধ কমবে, অপরাধী সনাক্ত করা সহজ হবে ইত্যাদি। সেটা হতে পারে, তবে এতেই যে এ ধরনের হামলা, নির্যাতন, হত্যা বন্ধ হবে এমনটি মনে করি না। আর সিসি ক্যামরা থাকলেও তা হয়তো থাকবে অকেজো, নয়তো অস্পষ্ট। অথবা দলীয় কর্মী ধরাশয়ী হবে সে জন্য তদন্তের আগেই সেই রেকর্ড নষ্ট করা হবে কিংবা ডিলিট করা হবে।
বদরুল ছিলেন ছাতকের আয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের খ-কালীন শিক্ষক। শিক্ষকতার চাকরি থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অনুরূপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে! কিন্তু এমন অপরাধীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না কেন? আর কত জঘন্য আচরণ করলে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে। বদরুলের ভাগ্য ভালো হলে শেষ পর্যন্ত সাময়িক শাস্তি পেয়ে আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে বেড়িয়ে যায় কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা যাতে আড়াল হয়ে না যায় সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। মামলার চার্জশিট যেন রাজনৈতিক গ্যারাকলে ঝুলে না থাকে তাই তদন্তের সাথে জড়িত সকল কর্মকর্তাসহ সকলেই ন্যায় বিচারের স্বার্থে কাজ করেন সে প্রত্যাশা করি।
বদরুলদের হাতে খাদিজারা আর কতদিন মার খাবে তা হয়তো জানা নেই। আহত অবস্থায় খাদিজাকে উদ্ধারকারী ইমরানের সাহস, শক্তি, অর্থ ও রক্ত দিয়ে মানবতার যে পরিচয় দিয়েছে তা অনন্য। সবশেষে বদরুলের মায়ের কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, তিনি বলেছেন, ‘বদরুল আমার সন্তান হতে পারে না। আমি চাই তার শাস্তি হউক। হামলাকারীর শাস্তি দেখে মরতে চাই।’ বদরুলের মায়ের দোয়া কবুল হোক, আমীন।
 লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন