শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক হালচাল

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সর্বশেষ খবর হলো- এ বিষয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা তাদের পরামর্শ গ্রহণের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর শেষে দেশে ফিরে গত ৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে গঠিত নির্বাচন কমিশন এক কোটি ৪০ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনে এমন ভুয়া ভোটার নেই। এটাই বোধহয় বিএনপির পছন্দ হচ্ছে না। আর নির্বাচন কমিশন গঠনের বেলায় বিএনপির পরামর্শ নিতে গেলে তো ওই ধরনেরই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যের পর নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা হবে বা তাদের পরামর্শ সরকার আমলে নেবে সেটা আশা করা আমার কাছে বাতুলতা বলেই মনে হচ্ছে। বরং সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য থেকে ইতোমধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অন্যান্য বিষয়ের মতো নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নেও সরকার একলা চলো নীতি শেষপর্যন্ত অবলম্বন করবে। তবে এ প্রক্রিয়ার গায়ে একটু হোয়াইট ওয়াশ (চুনকাম) করার লক্ষ্যে আস্থাভাজনদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি হয়তো গঠন করা হতে পারে। অবশ্য অভিজ্ঞজনেরা বলছেন যে, দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে ওই ধরনের সার্চ কমিটি গঠন ও সে কমিটির সুপারিশ মতো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও এ সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান হবে না। বরং এতে অসন্তোষের যে বীজ উপ্ত রয়ে যাবে তাতে নিকট ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারো অশান্তির ঝাড়-জঙ্গল বিস্তার লাভ করতে পারে।
অপরদিকে বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। এজন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ সংক্রান্ত আলোচনার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তারা বলছেন যে, আগামী নির্বাচনগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও কোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত করতে হলে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। আর সে কমিশন গঠন করতে হলে সরকারকে ‘একলা চলো’ নীতি পরিহার করে সবার মতামতের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটা ঠিক যে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শের বাধ্যবাধকতা সরকারের নেই। এ বিষয়ে আমাদের জাতীয় সংবিধানের ১১৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ একই অনুচ্ছেদের (৪) উপধারায় বলা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ সংবিধানের এ ধারা মতে রাষ্ট্রপতি কারো সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং গণতন্ত্রকে সংহত করতে দেশের জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিক সমাজ।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনবিষয়ক জটিলতা দীর্ঘদিনের। এমন একটি জাতীয় নির্বাচনও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি বা তোলা হয়নি। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের পরে পরাজিত দল বা প্রার্থীরা নির্বাচনে কারচুপি, জালিয়াতি, কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে থাকেন। এমন কি এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে সে সময়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দেশ-বিদেশে প্রশংসিত নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। পরাজিত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, নির্বাচন ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের সে বায়বীয় অভিযোগ কোনো মহলেরই সমর্থন পায়নি। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত বিএনপি, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আর ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন শুধু বিএনপি নয়, অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কেননা, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা যত নড়বড়েই থাকুক না কেন, ৩শ’ আসনের মধ্যে তারা মাত্র ২৯টি আসন পাবে এমনটা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে এ সরকারের (ফখরুদ্দীন-মইন উ) সব কাজের বৈধতা দেয়া হবে’Ñ এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগের জয়লাভের সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছিল।
বলা নি®প্রয়োজন যে, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনের অতীত ইতিহাসই একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য করে তুলেছে। যে নির্বাচন কমিশন আক্ষরিক অর্থেই শুধুমাত্র সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। বিশেষত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ‘অথর্বতা’ ও সরকারের আজ্ঞাবাহীরূপে প্রতীয়মান হওয়া শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির যৌক্তিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এটা বলা বোধকরি অতিশয়োক্তি হবে না যে, বাংলাদেশে গঠিত এ যাবতকালের নির্বাচন কমিশনগুলোর মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনই সবচেয়ে দুর্বল বলে সাধারণ্যে বিবেচিত হয়ে আসছে। অবস্থাটা এমনই যে, কোনো কোনো বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য পৃথক করাই কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশ-বিদেশে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য না হলেও কাজী রকিবউদ্দীনের কমিশন সেটাকে ‘চমৎকার নির্বাচন’ বলে প্রচার করেছে। এমন কি দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকগণ ওই নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে বললেও নির্বাচন কমিশন বলেছে যে, নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। ৩৫ শতাংশ ভুয়া ভোট যোগ করে সরকারের উদ্দেশ্য সফল করতে গিয়ে কাজী রকিবের নির্বাচন কমিশন খেয়াল করেননি যে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদের গায়ে অনৈতিকতার কালিমার ছাপ বেশ ভালোভাবেই লাগিয়ে নিয়েছিলেন এবং জনগণের কাছে নিজেদের অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা এবং সাড়ে চার হাজার ইউপি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে সচেতনমহল ‘একচোখা’ দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্যাপক সহিংসতা, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার-বাক্স ছিনতাই, প্রতিপক্ষকে ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, ভোটারদের ভোট দিতে না দেয়া ইত্যাকার সব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন ওইসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। ফলে সবার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মতো সরকারের তল্পীবাহক কমিশন দ্বারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে সব দল ও সুশীল সমাজের মতামতের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে অতীতের বিশেষত বিএনপির আমলে গঠিত কমিশনের উদাহরণ টানছেন। তারা এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, বিএনপি কারো সঙ্গে আলোচনা না করে এককভাবেই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। হ্যাঁ তাদের অভিযোগ অসত্য নয়। কিন্তু কথা হলো, অতীতের খারাপ দৃষ্টান্তই কেন বর্তমানে অনুসরণ করতে হবে? ভালো কাজ করে ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হিসেবে স্থান লাভ করতে অসুবিধা কোথায়? প্রতিটি রাজনৈতিক দলই প্রচার করে থাকে যে, তারা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়। দেশের সব মানুষ তাদের পেছনেই কাতারবন্দি। যদি সেটাই হয় তাহলে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে অসুবিধা কোথায়? বরং একটি নিরপেক্ষ কমিশনের অধীনে নির্বাচন হলে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোরই তো লাভ বেশি। তাহলে কেন এই গড়িমসি? এ প্রশ্নের অভ্যন্তরেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। মুখে জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদকে সর্বোচ্চে নিয়ে যাওয়া হলেও ‘বাস্তবতা’ ভীতি কাজ করছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। ফলে ‘গোপন নির্দেশের বাইরে যাবে না’Ñ এমন একটি কমিশন গঠনই এখন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধান তাদের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করছে।
এদিকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জনমত ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়াও সরকার সমর্থক ১৪ দল ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ এ বিষয়ে প্রায় অভিন্ন মত প্রকাশ করে চলেছেন। গত ৪ অক্টোবর দৈনিক যুগান্তরের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘তারা মনে করেন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন গঠন করা না হলে তা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠা ছাড়াও নির্বাচন নিয়ে নানা সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন পত্রিকাটিতে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে একটি আইন তৈরির কথা বলা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও কোনো দলই তা করেনি। যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা পকেট থেকে কিছু নাম বের করে কমিশন গঠন করেছে। যেহেতু আইন তৈরি করা হয়নি, তাই যে কোনো বিষয়ে সবাই একমত হলে কেউ তা চ্যালেঞ্জ করবে না। সে ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করা উচিত।’ একই প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। শুধু আলোচনা নয়, এ জন্য একটি আইন করা প্রয়োজন। কমিশন গঠনের লক্ষ্যে মহাজোট, বিএনপি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নাগরিক সমাজ ও আপিল বিভাগের একজন সিনিয়র আইনজীবী সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে একটি প্যানেল তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। তিনি এর অনুমোদন দেবেন।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবে এমন কিছু ঘটবে তেমন লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচন কমিশন হোক বা নির্বাচন এসব ঘিরে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসহীনতা। আর এ আস্থা বা বিশ্বাসহীনতার কারণও রয়েছে। কোনো দলই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থেকে সাংবিধানিক রীতি কিংবা আইনের প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারেনি। এমনকি জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের প্রমাণ দিতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। বলাই বাহুল্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার কারণেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল। ক্ষমতায় থেকে আরেকবার ক্ষমতায় যেতে উদগ্র নয়Ñ এমন আচরণ কোনো ক্ষমতাসীন দলই করেনি। বরং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে এমনসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম তারা দিয়েছে যা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একেকটি কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। বলা বাহুল্য যে, সে মানসিকতা এখনো পরিবর্তন হয়নি।
একটি বিষয়ে সবাই কমবেশি একমত যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই। বিএনপির মতো দুর্বল একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মাধ্যমে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভবও নয়। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের একমাত্র উপায় একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন। এ প্রসঙ্গে অনেকেই প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ দেন। সেখানে দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় ও রাজ্য সভার নির্বাচন হয়। কিন্তু পরাজিত দলগুলো কখনোই নির্বাচন সম্পর্কে কোনো অভিযোগ তোলে না। এর একমাত্র কারণ সে দেশের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, যা সংবিধান ও আইনের দ্বারাই পরিচালিত হয়, কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের ইঙ্গিত ইশারায় নয়।
একথা এখন স্পষ্ট যে, দেশের জনমত আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিরোধী দলবিহীন সংসদ ও রাজপথ পেয়ে অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে ওঠা ক্ষমতাসীন সরকার যে জনমতের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাবে সে আশা খুবই ক্ষীণ। যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ তারা এখনো আশাবাদী, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সরকার সবার সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তাদের এ আশাবাদ যে কখনোই বাস্তবে ধরা দেবে না সেটা বোধকরি তারাও জানেন। তথাপি তারা আশায় থাকছেন এ জন্য যে, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন না। নিকট অতীতের ঘটনাবলী সে সাক্ষ্যই দেয়। যেভাবে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ বিচারপতি এমএ আজিজের কমিশনকে হটিয়েছিল, সেটা যে বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয় এ কথা সবাই স্বীকার করেন। ফলে সরকারের সদিচ্ছা বা দয়ার আশায় বসে থাকা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। আর এ সরকার সে রকম সদিচ্ছা দেখাবে সে আশা করাও বাতুলতা মাত্র। সুতরাং সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
 লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সড়যড়হ@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন