মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দল হলো একটি প্রবাহমান নদীর মতো। নদীর উপকারিতা যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাও লিখে শেষ করা যাবে না। রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের ক্ষতির মনোভাব নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের কথা কল্পনাও করা যায় না। কোনো দূরদর্শী নেতৃত্ব এমন আত্মঘাতী চিন্তা কখনো করতে পারে না। বরং যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বকে দিতে হবে উৎসাহ পৃষ্ঠপোষকতা। ভেতর থেকে বদলে দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। কেননা নেতৃত্ব সংকটে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরা নদীর মতো হয়ে গেছে, দলগুলোর ভেতর কোনো প্রাণ নেই; নেই জনগণের মাঝে দলগুলোর জন্য কোনো আবেদন-নিবেদন। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচি আজ পরিণত হয়েছে জনবিচ্ছিন্ন ও পরিহাসের পাত্রে। রাজনীতি কোনো কিছুরই সমাধান দিতে পারছে না। বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজনীতি। প্রশাসনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে চলছে রাষ্ট্র; সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও দুঃখজনক ঘটনা হলো, রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করে। এটা রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য কোনো ভালো লক্ষণ নয়। আমরা যদি দেশকে উন্নত, আধুনিক ও মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করতে চাই তাহলে প্রয়োজন সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের। আসুন নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে আমরা ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় কয়েকটি দেশের দিকে নজর দেই।
একসময় মালয়েশিয়া ছিল শুধু পামঅয়েলের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ। কিন্তু নেতৃত্বের ক্যারিশমায় দেশটি এখন এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ। সিঙ্গাপুরের মানুষের আয়ের উৎস ছিল কৃষি ও মৎস্য আহরণ, কিন্তু দূরদর্শী নেতৃত্বে সেটিও এখন একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্র। কাজেই উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো দূরদর্শী নেতৃত্ব ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি, যেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃশ্যমান হচ্ছে না। এখানে আমরা লক্ষ করছি বুদ্ধিবৃত্তিকহীন, সুবিধাবাদী, অদূরদর্শী, হানাহানি, বিভক্তি-বিভাজন ও একে অপরকে খাটো করার রাজনীতি, যা দিয়ে উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করার কথা কল্পনাও করা যায় না।
দৃশ্যত আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বের কোনো প্রতিযোগিতা নেই। দলগুলো পরিচালিত হয় কার্যত একজন ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনে আর টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি। এমন গুনে ধরা, সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতি দিয়ে কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের আশা করা যায় না। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের পরিবর্তন যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সময়োপযোগী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বেরও, যা বেরিয়ে আসতে পারে প্রতিযোগিতামূলক নেতৃত্বের মধ্য থেকে।
কার্যত নতুন নেতৃত্ব তৈরি না হলে রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে না, বিকাশ ঘটে না নেতৃত্বেরও। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেন মরা নদীর মতো, এখানে রাজনীতি বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি বড় দল সরকার চালাচ্ছে প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আর অন্য বড় দলটির অবস্থা হলো, না ঘরকা না ঘাটকার মতো পর্যায়ে। তাই তাদের রাজনীতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কেন? উত্তর একটাই নেতৃত্ব। দলটির ভেতর নতুন কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না বা গড়ে ওঠার মতো সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে না। দল পুনর্গঠনের নামে হয় টাকা-পয়সা লেনদেনের খেলা। টাকা ছাড়া এই দলটি অন্য কোনো কিছুকেই বড় দেখে বলে মনে হয় না। অভিযোগ আছে টাকার বিনিময়েই এই দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদ বিলি-বণ্টন করা হয়েছে। তাই রাজপথে দলটির কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না, কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে তারা ঘরে বসে আরাম-আয়েশে সময় কাটান। এর নাম কি রাজনীতি? এর নাম কি নেতৃত্ব? এমন সুবিধাবাদী ও অদূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে ভালো কিছু অর্জন কী সম্ভব? এসব মানুষ এখন বোঝে আর বোঝে বলেই সুবিধাবাদী নেতৃত্বের পেছনে তারা দাঁড়াচ্ছেন না। ফলে রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তনও হচ্ছে না; ‘যে লাউ সেই কদুর মতো হয়ে’ রাজনীতি স্থির হয়ে আছে এক জায়গায়।
এই সুবিধাবাদী নেতৃত্বের কাছে প্রশ্ন, জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, লিঙ্কন, গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ভাসানী এবং জিয়াÑএরা কী সুবিধাবাদী নেতা ছিলেন? বাস্তবতা প্রমাণ করে এরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং সুযোগসন্ধানী ছিলেন না। যা-ই হোক, যদি অসৎ লোকেরা নেতৃত্বের পোশাকে আবৃত হয়, তবে তা হলো ভ-ামি, যাকে আদৌ নেতৃত্ব বলা যায় না। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নেতাদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এ প্রতিফলন কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণে ঘটলেই চলবে না, প্রবাসে অবস্থানকালীনও একই আচরণ বজায় রাখতে হবে। দেশীয় অহংকার নেতৃত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে।
প্রত্যেক প্রজন্মেই একজন দেশপ্রেমিক নেতা থাকেন, যিনি ভিন্ন কিছু করেন। চেষ্টা না করার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হেরে যাওয়া অনেক ভালো, ১৭৭৫ সালের মার্চে প্যাট্রিক হ্যানরি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। “আমরা যদি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে আমাদের লড়তে হবে। দ্বিধা এবং নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কখনো শক্তি অর্জন করা যায় না। জীবন কি এতই প্রিয় কিংবা শান্তি কি এতই মধুর যে শিকল ও দাসত্বের বিনিময়ে তা ক্রয় করতে হবে? নেতৃত্ব যখন প্রত্যয়ের চেয়ে সুবিধাকে বেছে নেয়, তখন রাজনীতির অবনতি ঘটে; রাজনীতি হয় কলুষিত, কলুষিত হয় নেতৃত্বও। আর জনগণের কাছে এই কলুষিত ও বিতর্কিত নেতৃত্বের কোনো আবেদন-নিবেদন থাকে না, তাদের ডাকেও জনগণ সারা দেয় না; বাস্তবেও আমরা তাই দেখছি।”
উৎসর্গ মানে সবসময় হারানো নয়, বরঞ্চ বেছে নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো বৃহত্তর অর্জনের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন। মহৎ নেতৃত্ব বিরক্তি নয়, বরং স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। যারা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন, তারা জীবিতদের মধ্যে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন। দেশকে ভালোবাসা মানে সামাজিক ত্রুটির প্রতি অন্ধত্ব কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রতি বধিরতা নয়। পরিবার ও জাতির জন্য ত্যাগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যখন পরিবারের জন্য ত্যাগ করেন তখন সে পরিবার লাভবান হয়। কোনো ব্যক্তি যখন জাতির জন্য কিছু করেন, তখন সে জাতি চিরতরে কিছু অর্জন করে। আত্মস্বার্থ ও উৎসর্গের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হলে দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই; নেই সফলতার কোনো সহজ ও নির্বিঘœ পথ।
আমরা নৈতিক রক্তাল্পতা ও আত্মিক ক্যান্সারে ভুগছি। সৎ ও ন্যায়বান লোকেরা দুর্নীতি ও আর্থিক অপুষ্টির মধ্যখানে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে। যারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে তারা নিকৃষ্টতম অপরাধী। পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে রয়েছে আমাদের সামাজিক নিন্দা। কিন্তু একজন পতিতা তার বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি করে। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক নেতৃত্বের কবলে পুরো জাতিই বিক্রি হয়ে যায়। কোনটি নিকৃষ্টতর? জেলিফিশ মাঝে মাঝে শামুক গিলে নেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত শামুকটি শক্ত খোলসে থাকে ততক্ষণ সে বেচে থাকে। কিন্তু টিকে থাকার জন্য তার খাবারের প্রয়োজন। তাই সে জেলিফিশের ভেতরটুকু খেতে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। সত্যের প্রকৃতি এমনই। এসব কিন্তু রূপকথা নয়। সব সময় ঘরের শত্রু সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। ব্রিটিশ যখন সমগ্র বাংলাকে তাদের দখলে নিতে চাইল, নবাবের উচ্চাকাক্সক্ষী মন্ত্রী মীরজাফর তাদের সাহায্য করল। পরবর্তীতে নবাব হওয়ার আশায় মীরজাফর তার শাসনকর্তা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরামর্শ দিলেন পলাশীর প্রান্তর থেকে সৈন্যদল ফিরিয়ে নিতে, যদিও ব্রিটিশ বাহিনীকে হটানোর জন্য তারা প্রাণপণ যুদ্ধ করছিল। নবাব তার উপদেশ গ্রহণ করে নিজের রাজত্ব এমনকি জীবন পর্যন্ত হারালেন। মীরজাফর এভাবে মাতৃভূমির সঙ্গে বেইমানি করে তা তুলে দিল বিদেশি দখলদারের হাতে।
আমরা শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরকেই দূষিত করতে পারে, যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালকে সম্মুখে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ, অনেকটা বৃষ্টি হলে আগাছা আর ফুল উভয়েই যেমন বাড়তে থাকে, ক্ষমতালোভী লোকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার তখনই যখন কারও প্রত্যাশা নোংরা হয়ে যায়।
প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ও দার্শনিকরা (আদর্শ রাষ্ট্রে) বিধান দিয়েছিলেন যে, দার্শনিক রাজার না থাকবে কোনো পরিবার, না থাকবে কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ। পরিবার না থাকলে আত্মীয়স্বজন বা সন্তান-সন্ততির প্রতি তার কোনো সময় দুর্বলতা জন্মাবে না। কোনো ব্যক্তিগত সম্পদে অধিকার না থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারে তিনি নিজে-নিজেই উদ্বুদ্ধ হবেন।
বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমরা একটা গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ফলে আমরা প্রতিনিয়ত নিচের দিকে নামছি। আমাদের সম্ভাবনার জায়গাগুলো শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে না, কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনকেও; এখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণত হবে অন্ধকারে। আমাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো পরিণত হবে দুঃস্বপ্নে। আমরা পরিণত হব পরমুখাপেক্ষী এক জাতিতে। একটি বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বই এখান থেকে আমাদেরকে বের করে আনতে পারে। বের করে আনতে পারে দেশকেও।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদার-নৈতিক, সংকীর্ণমনা নয়। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী; হতে হবে সংবেদনশীল, কঠোর মনা নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। কোথাও কোনো পর্যায়ে কোনো বিচ্যুতি ঘটলে ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিত্যাগ করার মানসিকতা তাদের অর্জন করতে হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন