শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

কুড়িগ্রামে তিস্তার নদী ভাঙনে দিশেহারা মানুষ

কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৫৯ পিএম

‘দুই দিনোত চাইর একর জমি তিস্তা গিলি খাইল বাহে। হামারগুলার বাড়ীঘর, জায়গাজমি সউগ শ্যাষ। হামরা এ্যালা কোটে যাই, কোটে থাকি। থাকপের কোন জায়গা নাই।’ কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি গ্রামের অসুস্থ্য কৃষক সুবির উদ্দিন (৭০) চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন কথাগুলো। তার বাড়ী লাগোয়া ছোট ভাই মহির উদ্দিনের পূত্র রহিমুদ্দি (৪৪) জানায়, ‘ওই যে পানি দেখছেন। ওই জায়গায় হামার দুই ভাই আর চাচার বাড়ি আছিল। বাড়ির পাশোত এক একর জমিত আলু লাগাইছিনু। নদীতে সব ধ্বংস। এখন হামরা নি:শ^ হয়া গেইলং।’
এরকম সরব আর নিরব কান্না ভেসে বেড়াচ্ছে কুড়িগ্রামের তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকাকে ঘিরে। গত এক সপ্তাহে তিস্তা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা আর স্বপ্নকে।
বৃহস্পতিবার সরজমিন এসব এলাকায় ঘুরে দেখা গেল ভাঙনের তান্ডব লীলা। প্রচন্ড ¯্রােতের তোড়ে রামহরি গ্রামের বাড়ীঘর আর গ্রামের ফসলি জমির মাটি চাপ চাপ করে ভেঙে নদীর ¯্রােতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। সেই কাচাপাকা ধান কাটছিলেন কৃষকরা। এই গ্রামের আব্দুল করিমের পূত্র কৃষক আব্দুল জলিল (৫২) জানান, ‘৬ বিঘা জমিতে ধান লাগাইছি। আর ১০/১২দিন পর কাটা যাইতো। সেই আধাপাকা ধানের জমির অর্ধেকটা নদী ভাঙনে শ্যাষ হয়া গেল। এখন বাকী ধান গরুকে খাওয়ার জন্য কাটা লাগছে।’
রামহরি ভূঁইয়াটারী গ্রামে রাহেলা বেগম (২৬) এর বাড়ীর কাছেই এসেছে নদী। স্বামী মমিনুল আর দুই সন্তানকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। রাহেলা জানান, ‘এবার নিয়া চারবার বাড়ী ভাঙছে। আমরা কামলা খাটি জীবন চালাই। নজিমুদ্দি ভূঁইয়া আমাদের দুরবস্তা দেখি এখানে থাকপের দিছে। এখন বাড়ী ভাঙলে আমাদের থাকবার বা বাঁচার কোন পথ থাকপে না।’ তার সাথেই বাড়ী ঢাকার গার্মেন্টস কর্মী আমিনুল ইসলামের। তার স্ত্রী পারভীন (২৮) জানান, ‘এই জায়গাতে ১০ বছর ধরি আছি। এতদূরে নদী আসবে কল্পনাই করি নাই। এখন বাড়ী ভাঙতে হবে ভাবতেই বুকটা হু-হু করি উঠছে।’
সবচেয়ে বেশি ভাঙছে ঘরিয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের উজানে সরিষাবাড়ী আর গতিয়াসাম এলাকায়। এখানে হু-হু করে ভাঙছে তিস্তা নদী। গতিয়াসাম বগুড়া পাড়ায় দেড় থেকে দুইশ জন লেবার কাজ করছে বাড়ী ভাঙ্গার কাজে। প্রতিটি বাড়ি থেকেই শোনা যাচ্ছে হাতুড়ি আর ছেনির শব্দ। যত্বে লাগানো গাছগুলোও কাটছে কেউ কেউ। সড়ানো হচ্ছে আধাপাকা ঘরের ইট, বেড়া আর টিনের চাল। এখানে একসাথে ১৭টি পরিবার বাড়িঘর স্থানান্তরিতের কাজে ব্যস্ত। সবার চোখে মুখে হতাশা আর বোবা কান্না। বাড়ীর সামনে উঠানে অযতœ আর অবহেলায় খোলা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্যবহারযোগ্য আসবাবপত্র।
এই গ্রামে নদী ভাঙনের শিকার লালবানু (৫০) সাংবাদিক দেখে ক্ষোভ নিয়ে জানালেন, ‘তোমরাগুলা ছবি তুলি কি করবেন। হামরা মরি যাই, আর তোমরা ছবি তোলেন। হামার যে ক্ষতি হয়া গেইল। তা কি সরকার দিবে।’
কলেজ পড়–য়া শাওন সরকার (২২) জানায়, এখানে মন্ত্রী আসে, এমপি আসে, জেলা প্রশাসক, ইউএনও স্যার আসে। শুধু দু:খ প্রকাশ করে শেষ। কিন্তু কোন কাজ হয় না। আমরা এই মূহূর্তে নদী ভাঙন রোধে দ্রুত কাজ চাই।
গত ২০ অক্টোবর হঠাৎ করে উজান থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীর প্রবল ¯্রােতে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার মানুষের বসতবাড়ী, গাছপালা, আবাদি জমি, আসবাবপত্রসহ ব্যবহার্য জিনিষপত্র। বন্যায় ক্ষতি হয়েছে পাশর্^বর্তী উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার প্রায় ৯ ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার মানুষের। এতে প্রায় ৫শ’ হেক্টর ধান, সবজি ক্ষেত বিনষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে ও ৪শ’টি পুকুরের মাছ। ভাঙনে দিশেহারা মানুষের মধ্যে কেউ কেউ জায়গা হারিয়ে এখন খোলা স্থানে রেখেছে ঘরবাড়ী। বাপ-দাদার স্মৃতি বিজড়িত আশ্রয়টুকু নদীতে বিলিন হওয়ার পর দিশেহারা মানুষের চোখ ফেঁটে বেড়িয়ে পরছে কান্নার ধারা।
ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থদের দেখতে এসেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো: এনামুর রহমান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. জাকির হোসেন, কুড়িগ্রাম সদর আসনের সাংসদ পনির উদ্দিন আহমেদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন, রাজারহাট ইউএনও নুরে তাসনিম সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ।
বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জানান, এই মূহুর্তে সরকারের উচিৎ বন্যায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে ভর্তূকি দেয়ার ব্যবস্থা করা। এছাড়াও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নদী ড্রেজিং করে নদী শাসনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে তিস্তা নদীর বাম তীরে ভাঙন কবলিত স্থানে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে জরুরী কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে উর্ধ্বতন দপ্তরে কারিগরি কমিটি গঠনের নোট প্রেরণ করা হয়েছে। কারিগরি কমিটি এখানে ভিজিট করে যে পরামর্শ দিবে সে মোতাবেক আমরা প্রকল্প প্রস্তাবনা গ্রহন করবো।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, তিস্তা নদীর ভাঙনে রাজারহাটের তিনটি ইউনিয়নে আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১ হাজার ১৭টি পরিবার। ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮৬৫টি পরিবার, ছিনাই ইউনিয়নে ১২২টি পরিবার এবং বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে ৩০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তা জন্য ৪ লক্ষ টাকা, ২০ মে.টন চাল, ৪শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার প্রদান করা হয়। এছাড়া মানবিক সহায়তার জন্য আরো ৮ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন