শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

অন্যেরে যত করিবে পীড়ন নিজে হবে তত ক্লীব

প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আল ফাতাহ মামুন
গেল ২ অক্টোরব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নারী নির্যাতনের ওপর করা তাদের দ্বিতীয় জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। জরিপে বলা হয়, ‘বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু পারিবারিক সম্মানসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে অধিকাংশ নারী নীরবে এ নির্যাতন সহ্য করেন।’ ফলাফল রীতিমত উদ্বেগজনক। পর দিন সবকটি জাতীয় দৈনিকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। তবে আশার কথা হলো, ২০১১ সালে প্রকাশ করা প্রথম জরিপের ফলাফলের চেয়ে এবারের ফলাফল কিছুটা ভালো। জরিপ মতে, ২০১১ সালে প্রথম জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ চার বছরে নির্যাতনের হার কমেছে ৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নারীশিক্ষার হার বাড়াতে পারলে এ ধরনের নির্যাতনের সংখ্যা আরো কমে আসবে।
দেশের সাতটি বিভাগের শহর, গ্রাম, সিটি কর্পোরেশন এবং সিটি কর্পোরেশনের বাইরের শহরকে জরিপের আওতায় আনা হয়েছে। শারীরিক, যৌন, অর্থনৈতিক, স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাবের কারণে এবং আবেগীয় নির্যাতনকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ২১ হাজার ৬৮৮ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০১ জন। মাঠপর্যায়ে ২০১৫ সালের ১৩ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বর্তমান এবং সাবেক স্বামী, বাবার বাড়ি, কর্মক্ষেত্রে কার মাধ্যমে কোন বয়সী নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, জরিপে এসব বিষয়ও তুলে আনা হয়েছে। জরিপ বলছে, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীরা শারীরিক নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকেন বেশি। দরিদ্র নারীদের বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জরিপমতে, স্বামীর হাতে নির্যাতনের ঘটনা সিটি কর্পোরেশনভুক্ত এলাকার তুলনায় গ্রামেই বেশি। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্যান্য শহরে নির্যাতনের হার ৭১ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বেশি। ৪১ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছেন, জীবনভর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে তাদের বিভিন্ন আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২৮ শতাংশের বেশি নারীকে আঘাতের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৪ শতাংশের বেশি নারী।
শুধু স্বামী নয় অন্যান্যদের মাধ্যমেও নির্যাতনের স্বীকার হন নারী। জরিপে ওঠে এসেছে এসব চিত্রও। এক-চতুর্থাংশের বেশি নারী বিভিন্ন সময় স্বামী ছাড়াও অন্য কারও হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিশোরীদের ক্ষেত্রে এ নির্যাতনের মাত্রা বেশি। ৩ শতাংশ নারী জীবনে স্বামীর বাইরে অন্য কারও মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বিবাহিত নারীর চেয়ে অবিবাহিত নারীরা এ নির্যাতনের শিকার হন বেশি। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের প্রায় ৪০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার অধিকাংশ নারী কখনোই নির্যাতনের কথা কাউকে জানায় না। পুলিশ, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ধর্মীয় বা স্থানীয় নেতার কাছে নির্যাতনের কথা জানানোর সংখ্যা খুবই কম। এ ধরনের অত্যাচারের শিকার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ নারী পুলিশের সহায়তা চান। কেন নির্যাতনের কথা জানাননি- এ প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ৩৯ জনের বেশি নারী বলেছেন, পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে, পুনরায় নির্যাতনের ভয় কিংবা লজ্জায় তারা বিষয়গুলো কাউকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করেন না। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে সহায়তা করার জন্য সরকার ২০১২ সালে ১০৯২১ নম্বরের একটি হেল্পলাইন চালু করে। অবাক হলেও সত্য! বিবাহিত নারীদের ৯৮ শতাংশ এ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে ৫ হাজার ৮৩৯ জন নারী ৩৩ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ তো রয়েছেই, রয়েছে যৌতুকের জন্য হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনাও। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরে। ‘অধিকারে’র এই হিসাব যেসব ঘটনার জানাজানি বা মামলা হয়েছে তার ভিত্তিতে করা হয়েছে। এ পরিসংখ্যানের বাইরেও রয়েছে অনেক ঘটনা। লোকলজ্জা ও হুমকির ভয়ে নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনাই আমাদের দেশে গোপন রাখা হয়।
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তা বিশ্বের কাছে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-েও নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান যে খাত পোশাক শিল্প, তার অধিকাংশ কর্মীই নারী। শিক্ষাগ্রহণ বা কর্ম উপলক্ষে প্রতিনিয়তই নারীকে ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে। কিন্তু ঘরে-বাইরে কোথাও নারী আজ নিরাপদ নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য! নারীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য যেসব আইন তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হয় না। সময় এসেছে ভেবে দেখার! কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও কেন নারী নির্যাতন ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গতানুগতিক ও প্রচারসর্বস্ব এবং দিবসনির্ভর কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নারী সংঘটনসহ সবাইকে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আরো গভীর ও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে সরকার এবং আপামর জনগণকে। জাতীয় কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়েই শেষ করছি-
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এরপর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে-পীড়া এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
শোন মর্তের জীব
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধষভধঃধযসধসঁহ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন