শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি প্রসঙ্গে প্রবাসী নেতৃবৃন্দের ভাবনা

প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস এম কামরুজ্জামান
সম্প্রতি গঠিত বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি নিয়ে প্রবাসী বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা ভাবনা চলছে। প্রবাসে গড়ে উঠা অতীতের আন্দোলন ত্যাগ ও সংগ্রামে নিজেদের অবদান মূল্যায়ন করতে চলছে বিভিন্ন ধরনের হিসাব নিকাশ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে কানাডা ও আমেরিকা থেকে যোগ্য ও উপযুক্ত কাউকে নতুন কমিটিতে স্থান না দেয়ায় সংশ্লিষ্টরা হতাশ হয়েছেন। শুধু এবারের কাউন্সিলে নয় আগের কমিটিতে আমেরিকা ও কানাডা থেকে উল্লেখিত পদগুলোতে কাউকে রাখা হয়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপিবিএনপির যত ভুল সিদ্ধান্ত তার মধ্যে এটি ও একটি বলে মনে করেন কানাডা ও আমেরিকার নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে কানাডার বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচন ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখেনি বা রাখতে পারছে না। উপযুক্ত পদ পদবি না থাকায় এসব কাজে প্রধান অন্তরায় বলে তারা মনে করেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়ে অগ্রসর হলে দলের তেমন কোনো লাভ হয় না। এতে ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থ অর্জিত হলেও দল বা দেশের কোনো কল্যাণ হয় না। আমেরিকা ও কানাডাতে ঠিক তাই হচ্ছে।
আমেরিকা ও কানাডা বিএনপির নেতৃবৃন্দের বক্তব্য হচ্ছে এই দুই দেশ থেকে অন্তত এক একজন করে দুই জনকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে পদায়ন করা দরকার। পাশাপাশি আমেরিকা ও কানাডাতে নতুন কমিটিও গঠন জরুরি। পৃথক পৃথকভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বর্তমান কানাডার সভাপতি ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, আমেরিকা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ সম্রাট, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সিনিয়র সহ-সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, আমেরিকা বিএনপির নেতা আবুল হাশেম বুলবুল, তোফায়েল লিটন চৌধুরী, আনোয়ার কামাল পাশা, শারাফাত হোসেন বাবুসহ কানাডা ও আমেরিকার বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে যাই বলুক না কেন আমেরিকা, কানাডা এই দুই দেশের মিত্ররাই গোটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এই দুই দেশের সঙ্গে বিএনপির দীর্ঘ মেয়াদি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যাতে দলের বা রাষ্ট্রের সুসময়ে ও দুঃসময়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। দেশের সমৃদ্ধি অর্জন ও টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের পাশে পাওয়া যায়। এমন চিন্তা ভাবনা থেকেই বিএনপিকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পশ্চিমের এই দুই দেশের নীতি নির্ধারিণীদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিকতা রাখা, আলোচনা ও লবিং করা, সঠিক বিষয়গুলো তথ্যসহকারে উপযুক্ত সময়ে তুলে ধরা এবং কেন্দ্রের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাজ করার এখনই সময়। আর এই কাজগুলো করতে হবে আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী বিএনপির নেতৃবৃন্দকেই। বছরে এক বা দুই বার বাংলাদেশ বা অন্য স্থান থেকে উড়ে এসে এসব কাজ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্পিকার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংগঠন, সিনেট, কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, কথা বলা সর্বোপরি যোগাযোগ রক্ষা করার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন। বিএনপির ঘোষিত ৫ জন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ৭ জন সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পক্ষে কি এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব? দুই একজনের এই যোগ্যতা থাকলেও এখানে না থাকার কারণে তা সম্ভব নয়।
অথচ কানাডা ও আমেরিকাতে বিএনপির জন্য ত্যাগী, নিবেদিত, অনুগত, সুশিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল সর্বোপরি পরীক্ষিত নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ থেকে এই দুই দেশে যারা কাজ করেছেন তাদের আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ বা সংশ্লিষ্ট ভালো পদ দিয়ে কাজে লাগানো উচিত নয় কি? কমিটিতে যুক্তরাজ্য থেকে ৪ জনকে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পদ। যাকে এই পদটি দেয়া হয়েছে তিনি যোগ্য ও উপযুক্ত। এই পদ লাভে তিনি যেমন খুশি হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন, তেমনি যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এতে বেশি লাভ হয়েছে বিএনপির। যুক্তরাজ্য বিএনপি আগের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সংগঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে লন্ডন যাত্রা বিরতিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্তিশালী বিএনপির তাপ অনুভব করেছেন। বিএনপির ঊর্ধ্বতন ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নিকট আমেরিকা ও কানাডা কি যুক্তরাজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি? নিশ্চয় না। যদি হতো তাহলে তো আমেরিকা ও কানাডা থেকে অন্তত ১০ জন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেতেন। শুধু তাই নয় আমেরিকা ও কানাডা কে বিএনপি সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার মর্যাদা দেয়নি। কেননা কেন্দ্রীয় কমিটিতে সৌদি আরব থেকে ২ জন ও মালয়েশিয়া থেকে ১ জনকে রাখা হয়েছে। অথচ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া এই দুই দেশ পশ্চিমাদের মুরব্বি মনে করে ও তাদেরকে মেনে চলে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যতদিন এই মূল্যায়ন ও উপলব্ধি সঠিকভাবে না করবে তত দিন পর্যন্ত ভুল পথে হেঁটে হেঁটে খেসারত দিতে থাকবে।
অন্যদিকে আমেরিকা ও কানাডাতে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী নাগরিক রয়েছেন যারা এক সময় দেশে বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখানে তারা ভার্সিটির শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাবেক কূটনীতিক, আমলা রয়েছেন যারা সমাজের উঁচু তলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশেও অনেকে উচ্চ পদ-পদবি ধারণ করতেন। তাদের বেশিরভাগ এখনো দেশ নিয়ে ও দল নিয়ে ভাবেন। এদের সংগঠিত করে একটি প্লাটফর্মে আনা যায় না? শুধু আমেরিকা ও কানাডায় নয় বিশ্বের অন্যানো দেশে এই অবস্থা রয়েছে। এ সকল মানুষদের সংগঠিত করতে বিএনপির কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
কেন্দ্রীয়ভাবে কি লোকাল বিএনপির নেতৃবৃন্দকে কখনো এই দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে? বিএনপিতে এই ধরনের চিন্তাভাবনা করার লোক আছে, তারা চিন্তাও করেছে কিন্তু বিএনপির উপর মহলে এই উদ্যোগ অপ্রোজনীয় মনে হয়েছে। অথচ এই সমস্ত গুণী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা যেত। তারা বিএনপিকে লোকালি ও আন্তর্জাতিকভাবে করণীয় নির্ধারণে উপযুক্ত ও সঠিক পরামর্শ দিতে পারতো। তারা বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করতো। তাদের এই পরামর্শ বিএনপিকে মানতে হবে তা কিন্তু নয়। আমেরিকাতে বিএনপির কমিটি নেই ২০১৩ সাল থেকে। এখন ২০১৬ চলছে। ২০১৪ সালে একটি কমিটি করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। ইতোমধ্যে বিএনপির ২ জন কেন্দ্রীয় নেতা আমেরিকা ও কানাডা সফর করে গেছেন। হয়তো কাজ চলছে। কমিটি নিয়ে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব মতবিরোধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কমিটি হবে না? মাথায় ব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলা কি সমাধান? তবে এটা সত্য বিএনপির এক শ্রেণির নেতা নেত্রীরা প্রবাসের কমিটিগুলো সুসংগঠিত হয়ে কাজ করুক তা চায় না। দলের মধ্যে মতভেদ, গ্রুপিং ও ঠেলাঠেলি থাকুক এটাই তারা কামনা করেন। কেননা যখন তারা আমেরিকা ও কানাডায় ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার সুবাদে বা স্বজনদের দেখতে বা সাংগঠনিক কাজে আসেন তখন দলের গ্রুপগুলো নেতানেত্রীকে খুশি করতে হোটেল ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া বিল দেয়া, দামি উপহার সামগ্রী তাদের হাতে তুলে দিতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এভাবে যে যতবার আসবেন ততবার তারা লাভবান হবেন। যিনি এভাবে উপহার সামগ্রী পাচ্ছেন তিনি কেন দল সংগঠিত হোক, তা চাইবেন? তিনি তো পারলে দলের ভেতরে আরো বিভক্তি করে অনেকগুলো গ্রুপ তৈরি করতে চেষ্টা করবেন। আমেরিকা ও কানাডায় এই অবস্থা বারবার দেখা গেছে।
বিএনপির চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে আমেরিকা সফর করেন। সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার সফর সফল ও সুন্দর করার জন্য ড. মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমেরিকার নেতৃবৃন্দ ছাড়াও কানাডা বিএনপির সভাপতি ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী এই আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। জানা যায়, এই আহ্বায়ক কমিটি আমেরিকার বিএনপির একটি খসড়া কমিটি তৈরি করে কেন্দ্রে জমা দিয়েছিল। তারও কোনো খবর নেই। কানাডাতে বিএনপির কমিটি গঠিত হয়েছিল ২০১১ সালের ২৪ জুলাই। তৎকালীন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফোনে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন।
বর্তমান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিনা রহমান এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী কানাডা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রবাসে আন্দোলন সংগ্রামে এই কমিটির ব্যাপক অবদান রয়েছে। ১/১১ সেই মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবাসে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলে কানাডা বিএনপি। দীর্ঘ দিন কাউন্সিল না হাওয়াতে দলের মধ্যে গ্রুপিং ও লবিং চলছে। কানাডা বিএনপির সভাপতি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কাউন্সিলের পক্ষে। তারপরেও কাউন্সিল হচ্ছে না। শুধু আমেরিকা ও কানাডাতে নয়। অধিকাংশ দেশের অবস্থা একই রকম। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই? বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও কমিটির বাইরে বিএনপি সমর্থক অনেক সাবেক মন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, সচিব, রাষ্ট্রদূত, আমলা, কূটনৈতিক রয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে সেল গঠন করে তাদের দায়িত্ব দেয়া উচিত। তাদের তদারকির জন্য থাকবে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি। বিদেশের বিএনপির কমিটিগুলো দেখাশুনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পাদকদের দায়িত্ব বণ্টনও জরুরি।
য় লেখক : সাবেক নিউজ এডিটর, দৈনিক দিনকাল, (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন