হোসেন মাহমুদ
বিশ^ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন এক বিরাট উচ্চতায় উপনীত হয়েছে বলে লক্ষ্য করছেন বিশ্লেষকরা। বর্তমান ভূরাজনীতি বাংলাদেশকে এ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার তথা নিজেদের প্রভাবের আওতায় রাখার দৃশ্যমান প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশে^র শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহÑ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়া। বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে বিশ^মনোযোগের এমন প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার ঘটনা সত্যিকার অর্থে এই প্রথম। বাংলাদেশ যে এখন তাদের কাছে উন্নয়নশীল বিশে^র মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দেশ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সামরিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে যাওয়া দেশ চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সে কথাই তুলে ধরেছে।
বর্তমান বিশে^র দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি ও কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠা পরাশক্তি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফর একটি ঐতিহাসিক সফরের মর্যাদা লাভ করেছে। বলা হয়েছে, গত ত্রিশ বছরে এটাই কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে চীনের প্রেসিডেন্ট লি জিয়াননিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন। গত ১৪ ও ১৫ অক্টেবর শি জিনপিং-এর দু’দিনের সফর ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আশা জাগানিয়া সফর। এত বড় অংকের অর্থনৈতিক সাহায্য কোনোকালে বাংলাদেশকে কেউ দেয়নি। বিশে^র সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রও নয়। সেক্ষেত্রে চীন পাকিস্তানে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তম বিনিয়োগের পর বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। সফরের প্রথম দিনেই চীনের ১৫টি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ১৩শ’ ৬০ কোটি ডলারের ১৯টি চুক্তি সই হয়েছে। ১৬ অক্টোবর ইনকিলাবের খবরে বলা হয়, এ সফরকালে বাংলাদেশ-চীন ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় বাংলাদেশ চীন থেকে ২৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পেতে যাচ্ছে। আর সব মিলিয়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সাথে বন্ধুত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অফুরান সম্ভাবনার সূচনা করেছে।
কোনো সন্দেহ নেই চীনের সাথে যে অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বন্ধুর মর্যাদায় যে দেশটি অভিষিক্ত হয়েছে সে দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ এ যাবত পেয়েছে ২শ’ কোটি ডলার মাত্র, তাও নানা কঠিন শর্তে। সে ক্ষেত্রে চীনের ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের ঘটনাকে অবিশ^াস্যই বলা যায়। সবারই জানা যে ভারতীয় ঋণ স্বার্থের সুকঠিন সংকীর্ণতায় জড়ানো, কিন্তু চীনা ঋণ তা নয় বা ততটা নয় যদিও চীনা ঋণের পিছনেও নিঃসন্দেহে ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে।
ঢাকায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক এখন নতুন যুগের সূচনা করেছে। ২০১৭ সাল হবে চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বছর। বাংলাদেশ ও চীন ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। আমরা এই দুই দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের জায়গা থেকে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কাজ করবো আর আগামী দিনগুলোতে এ হবে মূলকাজ। তিনি আরো বলেন, জঙ্গিবাদ ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করবে।’
তিনি আরো কিছু কথা বলেছেন যা থেকে দু’দেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিক পর্যায়েই বিন্যস্ত করার সকল রূপরেখা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে এ সহযোগিতার মধ্যে কোথাও সামরিক তথা প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দূরতম কোনো উল্লেখ নেই। এ বিষয়টি ভারতকে উদ্বেগমুক্ত রেখেছে। উল্লেখ্য, চীন অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশের সামরিক সহযোগী। অন্য কথায় বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে অস্ত্র কেনে। তবে সে বেশি পরিমাণের অর্থ প্রতিবেশী কোনো দেশের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করার মতো নয়।
এদিক দিয়ে ভারত উদ্বেগমুক্ত থাকলেও চীনের এ বিপুল পরিমাণ ঋণদানের ঘটনা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। মিডিয়ায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, চীনা প্রেসিডেন্টের এ সফরের ঘটনা ভারতের অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ১৫ অক্টোবর একটি অনলাইন মাধ্যমের খবরে বলা হয়, ঢাকায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর এবং ২৬ চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের ঘটনায় ‘অসন্তুষ্ট’ প্রতিবেশী ভারত। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেও চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হয়েছে। সে দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর ও বিপুল অর্থ ঋণের বিষয়ে উদ্বেগের আভাস দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে।
ভারতের প্রভাবশালী হিন্দি দৈনিক জাগরণ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের খবরে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমাতে চীনের কৌশল ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ গত দুই বছর ধরে এ চুক্তিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছিল শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই চুক্তি করলো বাংলাদেশ? পত্রিকাটি বলে, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব ও সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সবকিছু মিলিয়ে আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ চীনের কথিত ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ হয়ে উঠছে বলে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে।
টাইম অব ইন্ডিয়া গ্রুপের হিন্দি দৈনিক ‘নব ভারত’-এর এক প্রতিবেদনে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হওয়ায় ভারতের ওপর একটু কিছুটা চাপ সৃষ্টি করবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে কাজ করার ক্ষেত্রে ভারতের নিজের কৌশলগুলো আবারও ঝালাই করা উচিত।
এবিপি নিউজের এক খবরে বলা হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বঙ্গোপসাগরের কোলের বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের একাংশ। এই সফরের কারণে, ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তাতে কোনও প্রভাব পড়বে কি না সেই প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে।
১৫ অক্টোবর ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ-চীনের মধ্যকার সম্পর্ক, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা নীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ নিয়ে ঢাকায় এ পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি আশ^াস দেন। এ থেকে বোঝা যায় যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত ভারতের সম্ভাব্য উদ্বেগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সচেতন। তাই ভারতের গোয়ায় ১৫-১৬ অক্টোবর আয়োজিত ব্রিকস বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগেই নয়াদিল্লীর সে উদ্বেগ নিরসন করেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের প্রতিবেদক বাসুদেবন শ্রীধরন সবার চেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারতের প্রভাব থেকে বাংলােেদশকে সরিয়ে আনতেই চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। তবে তার এ বক্তব্য কতটা বাস্তবতা নির্ভর তা বলা মুশকিল। কারণ, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার অবস্থান শক্ত রাখতে ভারতের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। সরকারের কোনো কারণ নেই এ ভারত নির্ভরতা থেকে সরে আসার এবং তা সম্ভবও নয় নানা কারণে। এদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা সবাই এ ব্যাপারে একমত। তারা বলছেন, সরকার ক্রমেই যতবেশি সম্ভব ভারতের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। ভারতের জন্য বাংলাদেশের সদর-অন্দর সবই উন্মুক্ত করে দেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভারত যেমন এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ঢালাও সমর্থনের ছত্রছায়া বিস্তার করে রেখেছে তেমনি বাংলাদেশও যে কোনো সুযোগে ভারতের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিতে উদগ্রীব। এর সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ হলো পাকিস্তানের সাথে ভারতের চরম উত্তেজনার সময় ভারতের পাশে দাঁড়ানোর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। এ ঘোষণা দেয়া যে সমীচীন হয়নি, সম্ভবত তা উপলব্ধি করেই পরে প্রধানমন্ত্রী সুর বদল করে বলেন, পাকিস্তানের সাথে আমাদের ঝগড়াঝাটিও চলবে, আবার সম্পর্কও থাকবে। তার পাশাপাশি কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের প্রতি সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতাদের প্রকাশ্য সমর্থন দেয়ার ঘটনা দেশের বহু মানুষকে বিস্মিত করেছে। তা মুসলিম উম্মাহর অংশ ওআইসি সদস্য বাংলাদেশের জন্য কতটা সমীচীন হয়েছে তা নিয়ে কথা আছে। আরো আছে বিএসএফের কাছ থেকে বিজিবির প্রশিক্ষণ গ্রহণ নিয়েও। এ বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে পূর্বেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার অংশ হিসেবে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিজিবির ১৫ জনের একটি দল ভারত থেকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এসেছেন। উল্লেখ্য, ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বিশে^ কোনো প্রশংসিত দেশ নয়। তদুপরি গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশিদের নির্মমভাবে হত্যা করে আসছে। এ নিয়ে বহু প্রতিবাদ ও বৈঠক হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যা করে আসছে যারা সেই তাদের কাছেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণকে দেশের বহু মানুষই ভালো চোখে দেখছেন না। আর এক্ষেত্রে গণমানুষের মতামতকে সরকার গুরুত্ব দেয়ও না।
এবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারি বিরোধী দলকে গোণায় না আনা। তাঁর ২২ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফর ছিল শিডিউলে টাইট। এর মধ্যে তিনি সাক্ষাত দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। কিন্তু তিনি সাক্ষাত করেননি সরকার ঘোষিত বিরোধী দলীয় নেতা জাতীয় পার্টির বেগম রওশন এরশাদের সাথে। শোনা যায়, এ বিষয়টি জাতীয় পার্টির সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ এটাকে বিএনপির জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখছেন। কারো কারো মতে, এ ঘটনা নির্জীব বিএনপির প্রাণে শক্তি সঞ্চার করবে। নিরপেক্ষরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত থাকার দাবি সরকার করে, রওশন এরশাদের সাথে প্রেসিডেন্ট শি’র সাক্ষাত না করার মধ্য দিয়ে সে গণতন্ত্রের প্রতি চীনের গুরুত্ব না দেয়ারই প্রকাশ ঘটেছে। সরকার বিএনপিকে বিরোধী দলের অবস্থানে না রাখলেও যে কোনো অর্থেই বিএনপিই যে দেশের একমাত্র বিরোধী দল তা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই প্রধান বিরোধী দল, একাধিক বিরোধী দলও থাকে। তারা যেমন জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করে তেমনি সরকারি দলও তাদের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নরম-গরম জবাবে তাদের ধরাশায়ী করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এ রকম কোনো ব্যাপার দেখা যায় না। সরকার যে দলটিকে বিরোধী দল বানিয়েছে তাদের কয়েকজন সরকারেরই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। সে বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করার মতো কিছু পায় না। অন্যদিকে বিরোধী দল না হওয়া সত্ত্বেও সরকারের সব আক্রমণ-সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপি, যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে সরকার মুখে যাই বলুক, কার্যত বিএনপিকেই প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করে। বিদেশি সরকারগুলোও সে বাস্তবতাকেই স্বীকার করে বলে দেখা যায়। আগস্টে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও খালেদা জিয়ার সাথেই সাক্ষাত করেছিলেন, রওশন এরশাদের সাথে নয়।
শি জিনপিং-এর সফর উপলক্ষে পুরনো কথাও উঠে আসছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ পুরনো। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তা জোরদার রূপ না নিলেও পঞ্চম শতকে ফা হিয়েন ও সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং নামে কমপক্ষে দু’জন চীনা পর্যটক বাংলা ভূখন্ডে এসেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান চীন সফর করেন। চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া, এরশাদ, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা চীন সফর করেছেন ও দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমেই জোরদার হয়েছে। তবে এবারই তা প্রথম আকাশ ছুঁয়েছে। আর তাকে শেখ হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এ ধারণার সাথে অবশ্য অনেকেই একমত নন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কূটনীতি নয়, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিই আজ বাংলাদেশকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র আগামীর বড় হুমকি চীনকে মোকাবেলা করার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের সাথে হাত মিলিয়েছে। ভারত সাবেক সোভিয়েত ও বর্তমান রুশ প্রভাব বলয়ে থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র চীনা জুজুর মোকাবেলায় তাকে চায়। একইভাবে ভারত নিজের জন্য বড় হুমকি চীনকে মোকাবেলা করতে যুক্তরাষ্ট্র্রের মতো বিশ^সেরা সামরিক শক্তির সাথে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ছোট হুমকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পেশি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সে বাংলাদেশকে নিজের পাশে রেখেছে। তাই বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যেখানে স্বার্থের প্রশ্ন একতরফা তাকে প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক বলা যায় কিনা প্রশ্ন উঠতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়া গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের ন্যূনতম প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। এ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্গোপসাগর সংলগ্নতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশকে এবং পাকিস্তানের সাথে বিরোধ ও উত্তরপূর্ব ভারতের সাথে নিবিড় সংযোগ বজায় রাখার স্বার্থ আর দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠার স্বার্থ তিন বিশ^শক্তি ও এক আগামী বিশ^শক্তিকে বাংলাদেশের আঙিনায় টেনে এনেছে ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় আগ্রহী করেছে। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, বাংলাদেশ যদি দক্ষতার সাথে এ সব আগ্রহকে ব্যবহার করতে পারে তা দেশের জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে।
য় লেখক : সাংবাদিক
যথসধযসঁফনফ@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন