প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগের সেতু হিসেবে গড়ে উঠবে। যেসব ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবেন, তারা এখান থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার ধরারও সুযোগ পাবেন। সরকার দেশের উন্নয়ন সেভাবেই করে যাচ্ছে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২১’ উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যের দাবিদার। বাংলাদেশ এখন দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া একটি দেশ। বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ভারতকে বিশ্বের আগামী দিনের অর্থনীতির শীর্ষ পর্যায়ের দেশ হিসেবে ভাবা হয়। আরেক নিকটতম প্রতিবেশী চীন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর জন্য স্পুটনিক বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবেন তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার ধরার ও রপ্তানি করারও সুযোগ পাবেন। ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণের যেমন উদ্যোগ নিচ্ছে তেমন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ গড়ে তুলছে। দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে সন্তোষজনকভাবে।
আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গত চার বছরে বাংলাদেশে এক হাজার ১০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশের জন্য এটি কম নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ ডলার হয়েছে।
গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। এই কারণেই করোনা মহামারির মধ্যেও এফডিআই খানিকটা বেড়েছে বলে জানান তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
এই এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।
২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিসরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলোর ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপাদান হলো সস্তা শ্রম। কিন্তু এখন শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। সে জন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেসব শিল্প দেশের পুঁজি বাড়াবে এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন