শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

এটা জাজ্বল্যমান সত্য, একমাত্র আস্থাহীনতাই শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতার প্রধান কারণ। বিনিয়োগকারী আস্থা রাখবেন কিসের ওপর? সূচক, নাকি বিনিয়োগকৃত কোম্পানির ওপর? আর বিনিয়োগকৃত শেয়ার থেকেই বা আমরা কী পেতে পারি? নিশ্চয়ই লভ্যাংশ, যা ডিভিডেন্ড ইল্ড বিবেচনায় ব্যাংকের সুদহার বা অন্যান্য বিনিয়োগের চেয়ে লাভজনক কিনা, সেটিই মূল বিশ্লেষণের বিষয়। আর ক্যাপিটাল গেইন, সেটি তো সময়ের ব্যাপার। সেটিও দীর্ঘমেয়াদে ভালো শক্ত মৌল ভিত্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে অনেকটাই নিশ্চিত, যা গত দশ বছরের এই অস্থিতিশীল বাজারেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রোথ কোম্পানির ক্ষেত্রে ঢের প্রমাণিত। বিনিয়োগকারী কখনো ভেবে দেখে না। কোম্পানির গ্রোথ সূচক বোঝে না। অর্থাৎ সূচক কোম্পানির মুনাফায় কোনো প্রভাব ফেলে না, বরং মুনাফা দ্বারা সূচক সরাসরি প্রভাবিত। এটি সহজ সূত্র। কিন্তু অর্থনীতি তথা শেয়ারবাজারের এ সহজ সূত্রটি আমাদের শেয়ারবাজারে ঠিক কাজ করছে না। আসা যাক লভ্যাংশের কথায়। করোনার মহা সংকট দিন দিন কেটে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফিরছে গতি। ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণায়ও দেখা যাচ্ছে চাঙ্গাভাব। জুন হিসাব বছর হওয়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ কোম্পানি গত বছরের তুলনায় শেয়ারহোল্ডারদের বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৬৩টি কোম্পানির হিসাব বছর শেষ হয় জুনে। এর মধ্যে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ১৩৭টি, যার মধ্যে ১১৫টি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সর্বনিম্ন ১ থেকে ২৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ২১টি কোম্পানি এ বছর কোনো লভ্যাংশ দেবে না বলে জানিয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, লভ্যাংশ দিতে যাচ্ছে এমন ৭১ কোম্পানি মোট ১০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে, গত বছর যা ছিল ৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। গত বছরের চেয়ে মুনাফা বেড়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বা ৪২ শতাংশ। আবার এ মুনাফা থেকে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছে ৩ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যা নিট মুনাফার প্রায় ৩৪ শতাংশ। দেশীয় কোম্পানিগুলো ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর অজুহাতে কম লভ্যাংশ দিয়ে কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ড বা অবণ্টিত মুনাফা হিসাবে টাকা গচ্ছিত রাখে। ফলে আশাহত হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা মাথায় রেখে নৈতিকভাবে কোম্পানি পরিচালকদের আরও বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করা উচিৎ। তা হলে সাধারণ বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।

এ ক্ষেত্রে সরকারকেও বেশি লভ্যাংশ প্রদানের ভিত্তিতে কোম্পানিগুলোকে কর অব্যাহতি দেওয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে। মহামারি সংকট কাটিয়ে কোম্পানিগুলোর পণ্য ও সেবা বিক্রি বেড়েছে। এ কারণে বেড়েছে মুনাফা, এমনটাই জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। তারপরও ভালো, কী মন্দ কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই শেয়ারবাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরের মূল্যায়নে যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। যে কোনো বিবেচনায় অনেক ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ার আমাদের বাজারে এখনও অবমূল্যায়িত। এটি বিনিয়োগকারী হিসেবে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর এক প্রকার আর্থিক জ্ঞানের স্বল্পতার পরিচয়। এটা এভাবে বললেও অত্যুক্তি হবে না, এই অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক বিবেচনায় লজ্জার চোরাবালিতে ফেলে দিয়েছে আমাদের শেয়ারবাজারকে। গত দুই মাসে ক্রমাগত দরপতনে স্বস্তিতে নেই শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গত সেপ্টেম্বরে বেশিরভাগ শেয়ারদর হারালেও সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অক্টোবরে সিংহভাগ শেয়ারের সঙ্গে মূল্যসূচকের পতন শুরু হলে দরপতনের বিষয়টি আরও প্রকট আকারে দেখা দেয় এবং কমতে থাকে দৈনিক কেনাবেচার পরিমাণ। গত আগস্টে যেখানে দৈনিক আড়াই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো, এখন তা নেমেছে হাজার কোটিতে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অক্টোবরে তালিকাভুক্ত ৩৪৩ কোম্পানির মধ্যে শেয়ারদর কমেছে ৩০২টির, যা মোট শেয়ারের ৮৮ শতাংশ। এর মধ্যে ১৮০টি শেয়ারের দর কমেছে ১০ থেকে ৩৪ শতাংশ। ৫ থেকে প্রায় ১০ শতাংশ দর কমেছে আরও ৬৪টির। বিপরীতে মাত্র ৩৬টি শেয়ারের দর বেড়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড খাতের চিত্রও একই রকম। ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর কমেছে ২৮টির এর বিপরীতে দর বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৪টির। বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় শেয়ারের দর কমবেশি বেড়েছিল। এর পর বাজার এখন গুটিকয়েক শেয়ারনির্ভর হয়ে পড়েছে। হামিদ ফেব্রিক্স, শেফার্ড, ফরচুন সুজ, সোনালী পেপার ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারের দর ৩৬ থেকে ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট বড় মূলধনী শেয়ারদরেও ছিল ঊর্ধ্বমুখী দাপট। এসব দুর্বল মৌলভিত্তি শেয়ারদর বৃদ্ধিই প্রমাণ করে বাজারে কারসাজি চক্র সক্রিয়।

গুণগত বিনিয়োগ বা নীতি নৈতিকতা নিয়ে ভাবার যেন অবকাশ নেই। যে কোনো উপায়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়াই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মূল মতলব। এই বাসনায় তারা যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে সদা প্রস্তুত। তারা ভুলে যায়, শেয়ারব্যবসা অত সহজ নয়। এখানে অনেক ঝানু, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিও ব্যবসা করতে গিয়ে ফতুর হয়েছে। আবার দু-একজন কোটিপতি হয়েছেন। ছোট-বড়-মাঝারি সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অনুসরণ করে বা আদর্শ মনে করে। ফলে ২০১০ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ২০১০ সালের বিপর্যয়ের রেশ থেকে শেয়ারবাজার এখনো বের হতে পারেনি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে এখনো দুই-একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আদর্শ সফল বিনিয়োগকারী গড়ে ওঠেনি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যাদের আদর্শ মনে করবে, তাদের বিনিয়োগ সফলতা শুনে ভরসা পাবে। আর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ মানসিকতা গড়ে তুলবে। একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগই বাজারকে স্থিতিশীল করবে।

অনেকের মতে, সম্প্রতি শেয়ারবাজারের অস্থিরতার মূল কারণ প্রধান মূল্যসূচকের দ্রুত উত্থান। গত ২৭ জুন সূচকটি ৫ হাজার ৯৯২ পয়েন্ট থেকে মাত্র ৩৮ কার্যদিবসে ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে। আর সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্টে পৌঁছাতে সময় নেয় মাত্র ৬৪ কার্যদিবস। ফলে টনক নড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বিএসইসি সূচকের উত্থান থামাতে সচেষ্ট হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শেয়ারবাজারে অনিয়ম পেলে তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে কৌশলী বড় বিনিয়োগকারীরা সতর্ক বিনিয়োগ নীতি নেয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রায়ই দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির সমন্বয়হীনতা, যা সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা ভুলে যাননি ২০১০ সালের বাজার ধসের অন্যতম কারণ ছিল এই সমন্বয়হীনতা। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করে, দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থাই বাজারের স্বার্থে কাজ করে। মতের বিরোধ থাকতেই পারে। সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ দুই প্রতিষ্ঠানের যে কোনো আচরণই বাজারের জন্য সংবেদনশীল, যা এভাবে জনসমক্ষে প্রচার হওয়া ঠিক নয়। এতে অবশ্যই একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন