আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর থেকে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে। এভাবে টানা তিন মাস ফ্লাইট উঠানামা বন্ধ থাকবে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এলাকায় ‘স্থাপনা নির্মাণ’ কাজের কারণে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এমন সিদ্ধান্তের কারণে যাত্রী সেবা বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। শুধু তাই নয়, বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে নিয়মিত যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। শুরুতে টার্মিনালটি নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে প্রকল্প ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এ প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকারও বেশি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বাকি ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। ২০২৩ সালের জুন মাসে এই টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের ১১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন রাত ১২টার পর থেকে সকাল ৮টা অবধি একটানা তিন মাস বিমান বন্দরে রাত্রিকালীন সকল ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকবে। এ সময়ে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে কোনো ফ্লাইট ওঠানামা করার অনুমতি পাবে না। এমন সিদ্ধানের কারণে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকবে বলে স্বীকার করেছেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে যাত্রীর চাপ ও হয়রানি যাতে না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে রানওয়ে বন্ধ থাকলেও বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কাজে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ সময় কোনো ফ্লাইটের জরুরি অবতরণের প্রয়োজন হলে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে বেবিচক।
এ ব্যাপারে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রæপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ কাজের জন্য রানওয়ে বন্ধ থাকবে। সকল এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে নতুন সিডিউল দেয়া হয়েছে। এই সিডিউলেই ফ্লাইট উঠানামা করবে।
এদিকে বিমানববন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছরই ঘন কুয়াশার কারণে নভেম্বর থেকে শীতকালীন ফ্লাইট-সূচি অনুসরণ করা হয়। বিশেষ করে শীতকালে রাত ২টা থেকে সকাল ৮টা/৯টা পর্যন্ত কুয়াশা বেশি পড়ে বলে ফ্লাইটগুলোর রানওয়ে ভিজিবিলিটি কম থাকে। এ কারণে বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ অবতরণে সমস্যা হলে ফ্লাইটগুলোকে নিকটস্থ অন্য কোনো বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়। তবে টানা আট ঘণ্টা রানওয়ে বন্ধ থাকলে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়বে এবং হয়রানির শিকার হবে। এরই মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন কয়েকজন যাত্রীর সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
শুয়াইব হাসান নামের এক সাংবাদকর্মী ইনকিলাবকে জানান, তিনি গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তহে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়েছিলেন। তবে যেদিন তার ফ্লাইট ছিল সেই দিন সকাল ১০টার দিকে বিমানবন্দরে উপস্থিত হন তিনি। আরটিপিসিআর টেস্টের পর ওই দিন সন্ধ্যায় ফ্লাইট হওয়ার আগে অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, সারাদিন অপেক্ষার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু ইমিগ্রেশন করতে গিয়ে তার বিদেশযাত্রা অনিশ্চয়তায় পড়ে। যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্তে¡ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তাকে আটকে রাখেন। সেই সময় কী কারণে তাকে আটকে রাখা হয়েছে কিছুই জানাননি সংশ্লিষ্টরা। অথচ ঠিক একই সময় নিকটবর্তী আরেকটি সারিতে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দ্রæত সামনে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। একজন কর্মকর্তার হাতে যাত্রীদের তালিকা সম্বলিত একটি কাগজ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে বলেও জানান শুয়াইব।
ওই দিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন জানিয়ে শুয়াইব বলেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন কর্মকর্তাকে ডাকলাম। আমাকে আলাদা টেবিলে আটকে রাখার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ পর অন্য একটি কক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানেও আমাকে অপেক্ষায় রাখা হলো। এক পর্যায়ে জানতে চাওয়া হলো- আমি এর আগে দুবাই গিয়েছি কি না। এটি আমার প্রথম দুবাই সফর জানিয়ে আমার ফিরতি টিকেটের কপি এবং হোটেল বুকিংয়ের কপিসহ যাবতীয় কাগজপত্র দেখাই। তবুও কোনো কিছু না বলে আমার পাসপোর্ট রেখে কক্ষ থেকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বের করে দেওয়া হলো।
বিমান ছাড়ার নির্ধারিত সময়ে মাত্র ১৫ মিনিট বাকি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, চরম হতাশা অনুভব করি এবং সিলেট ও ঢাকায় পরিচিত কয়েকজনকে সহযোগিতার জন্য ফোন করি। কিন্তু তারাও কিছু করতে ব্যর্থ হন। তখন আরও চার থেকে পাঁচজন যাত্রী আমার সঙ্গে একই পরিণতির শিকার হন। আমি জানতে চাইলে তারাও নতুন যাচ্ছেন এবং আগে ইমিগ্রেশনে কন্টাক্ট করেননি বলে জানান। আমিও তাদের মতো একজন ছিলাম। একপর্যায়ে কর্মকর্তার সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলি এবং আমাকে আটকে রাখার প্রকৃত কারণ জানতে চাই। ওই কর্মকর্তা পরবর্তীতে অন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে আমাকেসহ অন্যদের নিয়ে যান। আমি যেহেতু নিজেকে সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়েছি এবং আমার কাগজপত্র সঙ্গে রয়েছে; এজন্য প্রথমে আমাকে ডাকা হয়।
বড় কর্মকর্তা আমার এনওসি (ছুটির কাগজ) এবং হোটেল বুকিংয়ের কাগজ দেখাতে বলেন। আমি সেটি ফাইলে আছে জানাই। তিনি ফাইলের কাগজপত্র উল্টিয়ে দেখেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাক্ষর দিয়ে আমাকে ইমিগ্রেশনের অনুমতি দেন। বের হয়ে যেদিকে নিয়ে আসা হয়েছে, সেদিকে যেতে চাইলে আবারও একজন কর্মকর্তা আটকে দেন। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে এদিকে যাওয়া যাবে না বলে জানান। কিন্তু বিমানের নির্ধারিত ইমিগ্রেশনের জায়গায় যাওয়ার পথ ছিল না। এখানে অন্য বিমানের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া চলছিল। এ কারণে ওখানে বসা কর্মকর্তা আমার ইমিগ্রেশন করতে অপারগতা দেখান এবং এক ধরনের ধমকের সুরে কথা বলেন। অথচ আমার ইমিগ্রেশন ফটকটি অনেক দূরে। সেখানে যেতে হলে বাইরে বের হয়ে ঘুরে যেতে হবে। এর মধ্যে হয়তো আমার ফ্লাইটের ইমিগ্রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বিমান ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি। অনেক অনুরোধের পর তিনি আমার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন।
তিনি আরো বলেন, ওইদিন প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরি করে ফ্লাইট হয়েছিল। অন্যথায় আমার দুবাই ভ্রমণ অসম্ভব ছিল। একইসঙ্গে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। যদি আটকা পড়তাম তাহলে আমার আগ্রহ আর আর্থিক ক্ষতি কি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বহন করত?
তিনি বলেন, ১২ দিনের দুবাই ভ্রমণে অনেক কিছু দেখেছি, শিখেছি। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া দেখে ভালো লেগেছে। দুবাই বিমানবন্দরে অনেক হাটতে হয়েছে; তবে ইমিগ্রেশনে ১০ মিনিটও দাঁড়াতে হয়নি। তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের কর্মকর্তারা শিক্ষা নিতেন। তাহলে আমাদের বিদেশগামী প্রবাসী ও যাত্রীরা এত হয়রানির শিকার হতেন না। শুধু শুয়াইব হাসান নয়, তার মতো অনেক যাত্রী এভাবে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে পুলিশ সদস্যদের কাছে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তারা ফোন রিসিভ করেনি।
সূত্র মতে, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, এমিরেটস, সউদীয়া এয়ারলাইনস, তুর্কি এয়ারলাইনস এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সসহ ২৭টি এয়ারলাইন্স ৯০ থেকে ১০০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে। এতে প্রায় ১০ হাজার যাত্রী শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করেন। তবে টানা আট ঘণ্টা রানওয়ে বন্ধ থাকায় এয়ারলাইন্সগুলো আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের নতুন করে শিডিউল করতে হয়েছে। মাত্র ১৬ ঘণ্টার মধ্যে ৯০ থেকে ১০০টি ফ্লাইট ওঠানামা করায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়বেন বলে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স অপারেটররা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিদেশি এয়ারলাইন্সের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়তে হবে। এই সুবিধা না বাড়ালে যাত্রীরা চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। এছাড়াও ইমিগ্রেশন পুলিশের হয়রানি তো রয়েছেই।
আরেক কর্মকর্তা জানান, ১৬ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত ফ্লাইট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক চেক-ইন কাউন্টার, বোর্ডিং ব্রিজ, নিরাপত্তা চেক-ইন কাউন্টার, ব্যাগেজ লোডিং এবং আনলোডিং সুবিধা এবং অন্যান্য সম্পর্কিত সুবিধার প্রয়োজন। তবে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) বলছে, রানওয়ে বন্ধের ফলে তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। তারা বলছে, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন অপারেটর এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তারপরও কোনও ব্যাঘাত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, আট ঘণ্টা বন্ধ থাকায় একটু যাত্রীর চাপ বাড়বে। তবে সেই সময় কি করতে হবে সেটা আমরা পরিকল্পনা করেছি। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা যদি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে তা হলে যাত্রীর চাপ বা হয়রানি হবে না বলেও জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন