বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

এরা আসলে কেমন জনপ্রতিনিধি

প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম
শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’-এ সেøাগান নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর হতে দেশের অতিদরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ শুরু করে সরকার। হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের এ ত্যাগ বেশ প্রশংসিত হয়। এমন সিদ্ধান্তে সমাজের অভাবী মানুষের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু গরিবের এ চাল ভোগে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এদেশীয় প্রতিভূরা। এ ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’ শুরু হতে না হতেই নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। হতদরিদ্রদের ১০ টাকা দরে চাল বিতরণ কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিও কাজে আসছে না। এ অল্প সময়ে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ১১টি ফৌজদারি মামলা ও ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৪৪ জনের ডিলারশিপ বাতিল, চালের ওজনে কম দেয়ায় ৯ জন ডিলারকে জরিমানা ও অভিযুক্ত খাদ্য কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। তাতেও আরব্য উপন্যাসের ‘থিপ অফ বাগদাদের’ এ দেশীয় চোরসমাজ একটুও থেমে নেই। কথায় বলে ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’। এ অবস্থায় সরকারের ত্যাগ; অন্যদিকে এ সমাজের টাউট, বাটপারদের কারসাজিতে ধনশালীদের ১০ টাকার চল ভোগের কারণে এ মহৎ প্রকল্পটির সুনাম ধুলায় ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। রূপকথার বাগদাদের বংশধর ‘থিপ অফ বাংলাদেশ’-এর এদেশীয় চোরদের সামাল দিতে না পারলে তা সরকারের বিড়ম্বনারই কারণ হবে।
শুনতেই লজ্জা লাগে; গা ঘিন্ঘিন্ করে। গরিবের চাল নিকি যায় জনপ্রতিনিধি আর দলীয় নেতাকর্মীদের ঘরে। এরা আসলে কেমন জনপ্রতিনিধি? এরা কেমনতর নেতা? অতিদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজির চাল কি করে ওরা লুটে নেয়? এসব নষ্ট সমাজে কিটের কারণে বিতরণের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে সরকারের এ মহান প্রকল্প। গরিবের চাল চলে যাচ্ছে কালো বাজারে, চাল না পেয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। সরকারের এ উদ্যোগে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ২১৪৪.৭৮ কোটি টাকা। খাদ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে ১০ টাকার চাল বিতরণ করা হবে মোট সাড়ে ৭ লাখ টন। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগ নানা অনিয়মে ভেস্তে যেতে বসেছে। অনেক হতদরিদ্রকে বাদ দিয়ে অবস্থাসম্পন্ন ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বজনপ্রীতি দেখানো হয়েছে। এই অনিয়ম ও অভিযোগগুলো সব উপজেলাতেই পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও নিয়োগ করা হয়েছে দলীয় ডিলার, উপযুক্ত ভুক্তভোগীদের তালিকায় না রাখা, সচ্ছল দলীয় নেতাকর্মী অন্তর্ভুক্তি, কালোবাজারে চাল বিক্রি, ওজনে কম দেওয়া, কম দামের চাল বেশি দামে বিক্রি করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের চিত্রে অনেকাংশেই শঙ্কা দেখা দেয় যে এ ভর্তুকির ২১০০ কোটি টাকার পুরোটাই গচ্চা যায় কিনা। অতি দরিদ্রদের জন্য ত্যাগ করছে সরকার আর ভোগ যদি করে ধনুশ্রেণীর জনপ্রতিনিধি, নেতাকর্মী আর প্রশাসনের লোকজন তাহলে এ প্রকল্প তো ভেস্তে যাবেই। অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয় এদেশে নতুন নয়। সব ক্ষেত্রেই হয়। এখানেও হচ্ছে তদাই বলে হতাশ হবার কিছু নেই সরকার শক্ত হাতে এর প্রতিকার করলে সুফল আসবেই। এ মহৎ কাজটি যেন কিছুতেই ভেস্তে না যায়। দরিদ্ররাই যেন অল্প দামের চাল ঘরে নিতে পারে ব্যবস্থাটা সরকারকেই করতে হবে। কাজটি করতে গিয়ে সরকার যেমন বাহবা পেয়েছেন তাতে ব্যর্থ হলে জনগণের কাছে সরকারের মুখ আর উজ্জ্বল থাকবে না। এ জাতীয় দুর্নীতি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে বৈকি!
পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশি দুর্নীতি আছে, এই কথাটির আপেক্ষিক সত্যতা মেনে নিয়েও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করার কোন অজুহাত নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এই দুর্নীতি যা আগেই বলেছি, জনগণের মনে ব্যাপক হতাশাবোধের জন্ম দিয়েছে। এই হতাশাবোধের মূল কারণ হচ্ছে যে, দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার আমাদের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের কার্যকর ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে এই যে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দুর্নীতি। আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র কাঠামোতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। সাধারণ জনগণ যেকোন ক্রান্তিলগ্নে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাগরিকের আস্থা এবং নির্ভরতার আশ্রয়স্থল হবে সেসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দিনদিন আস্থা হারাছে তারা। আমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকশিত হতেই দিচ্ছি না, বরং কলুষিত করেই চলেছি প্রতিদিন। এখন এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের আঁতুড়ঘর।
খাদ্যবিভাগের চাল বিতরণে সম্প্রতি অনিয়ম দেশের মানুষকে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমরা তো ব্যথিত হচ্ছিই। অভিযোগ উঠেছে, দেশের অনেক স্থানে অতিদরিদ্ররা চাল বিতরণের তালিকায় স্থান পাননি। দলীয় বিবেচনায় বা ঘুষের বিনিময়ে সচ্ছল মানুষদের কার্ড দেয়া হয়েছে। অনেকের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে একাধিক কার্ড। এমনও দেখা গেছে যে, জালিয়াতি করে মৃত ব্যক্তির নামেও কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে প্রকৃত দুস্থ ব্যক্তি কার্ড পেলেও তাদের অনেকের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে ডিলারশিপ নিয়েও। অনেক স্থানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। এতো হতাশার মধ্যে আশার আলো হয়ে উঠেছে সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারিত কঠোর হুঁশিয়ারি। তিনি সাফ সাফ বলে দিয়েছেন ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণসহ হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে কোনো অনিয়ম বা গরমিল সহ্য করা হবে না। অনিয়ম পাওয়া গেলে ডিলারদের ডিলারশিপ বাতিলসহ তালিকা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংসদ সদস্যসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নিজ নিজ এলাকার তালিকা যাচাই-বাছাইসহ অনিয়ম খুঁজে বের করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আমরা আশা করব শুধু নির্দেশ দেওয়ার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকবে না। যথাযথ কার্যকর করা হবে বিবেচিত হবে এমনটিই আশা করা যায়। চাল নিয়ে চালবাজি এখনই বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত গরিব, অসহায়, দুস্থরা চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দশ টাকার চাল যাচ্ছে ধনীদের বাড়িতে। বাদ যাননি জনপ্রতিনিধির সম্পন্ন স্বজনরাও। পত্রিকার খবরে দেখেছি ১০০ বিঘা জমির মালিকও ১০ টাকার চাল পাচ্ছে। এই হচ্ছে দশা।
এ অবস্থায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কবিতার দু’টি চরণ মনে পড়ছে আমার ‘তিনভাগ গ্রাসিয়াছো একভাগ বাকী/সুরা নাই পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী। দেশে দুর্নীতির যে অবস্থা তাতে অবশিষ্ট বোধকরি ১ ভাগও নেই। তবে ঘুষ ও দুর্নীতি নতুন কোন বিষয় নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এ রেওয়াজ চালু রয়েছে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার রচিত ‘মুচিরাম গুড়’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘বাঙ্গালা দেশে মনুষ্যত্ব বেতনের ওজনে নির্ণীত হয়। কে কত বড় বাঁদর তার লেজ মাপিয়া ঠিক করিতে হয়।’ তখনকার কেরানি আর চাপরাশিদের চুরিচামারি করে সামান্য ঘুষ গ্রহণের নমুনা দেখেই তিনি লিখেছেন ‘এমন অধঃপতন আর কোন দেশের হয় নাই।’ ভাগ্যিস বেঁচে নেই সেই সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো অতিদরিদ্রদের চাল নিয়ে জনপ্রতিনিধি, নেতাকর্মী আর প্রশাসনের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এদেশের দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে তার লেখনীতে মহাপ্রলয় ঘটিয়ে ছাড়তেন। এ দেশে ঘুষের অবাধ স্বাধীনতায় সাধারণ মানুষের হতাশা আর মর্মবেদনার কথা নতুন নয়। আমরা ভাগ্যাহত এ কারণে এ দেশের জ্ঞান পাপীরা শিক্ষার পাহাড় মাথায় নিয়ে নির্বিচারে নির্লজ্জ দুর্নীতি আর ঘুষগ্রহণে মেতে থাকেন। আমরা ভাগ্যাহত এ কারণে কোন সরকারই ঘুষ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না; যতটা না তাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন ছিল। প্রাসন যন্ত্রকে ঘুণে ধরানো যে কত বড় জাতীয় আত্মহত্যা তা আমরা বুঝলাম না; বুঝলাম না লুটপাটজনিত দলীয় শাসনের পরিণতিস্বরূপ। ইতিহাসই এর সাক্ষ্য দেয়। এর পরিণাম কখনই ভালো হতে পারে না। ভালো হয় না।
জনমনে প্রশ্ন যে, দুর্নীতির এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে কীভাবে মুক্ত হওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে যে কেন দুর্নীতি হয় বা দুর্নীতি বিস্তারের প্রক্রিয়া কীভাবে বৃদ্ধি পায়। সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সাথে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। যেখানে দরিদ্রদের ১০ টাকা কেজির চাল নিয়ে ঘটেছে। এ কথার সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয় যে কেবলমাত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কেননা দুর্নীতি পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করে তা তুলনাহীন। এই হতাশার ফল ধরে আমরা হয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কোন অতিরঞ্জিত ফলাফলে দুর্নীতির শীর্ষমুকুট আমাদের উপহার দেয়নি, আমাদের জনগণের ব্যাপক হতাশাবোধকেই কেবল তুলে ধরছে। অতিদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণে অনিয়মের বিয়টি এদেশের দুর্নীতির স্থান আরও এগিয়ে নিয়ে আসবে। যা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখনই কঠোর হস্তে এ দুর্নীতি রোধ করতে হবে। সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্ট সবাই তাতে সচেষ্ট থাকবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন