মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

পাকিস্তানকে একঘরে করার ভারতীয় প্রয়াস ব্যর্থ

প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল : কাশ্মীরে সীমাহীন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা আড়াল করা এবং আসন্ন উত্তর প্রদেশসহ বেশ কিছু রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে ফায়দা হাসিলের জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার পাকিস্তানবিরোধী উন্মাদনা সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তানকে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে একঘরে করা এবং অপারেশন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নাটক সবই এই কৌশলেরই অংশ। তবে এই কাজে ভারত খুব একটা মুন্সিওয়ানার পরিচয় দিতে পারেনি। ভারত দখলকৃত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে উরি সেনা ছাউনিতে এক হামলায় ১৮ ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনার সূত্র  ধরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে একঘরে করার উদ্যোগ নেয়। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে। তবে ভারত এ কাজে মোটেই সফলকাম হতে পারেনি। ভারত অনুগত শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশ সক্রিয়ভাবে ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি। তবে ভারত ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্কশীর্ষ সম্মেলন ভ-ুল করতে সক্ষম হয়েছে। হয়তো এটিই ভারতের নোংরা কূটনীতির একমাত্র সফলতা। এক্ষেত্রে সার্কের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র বাংলাদেশ ভারতের পাশে দাঁড়ায়। সাথে যোগ দেয় ভারতের নিয়ন্ত্রিত দেশ ভুটান এবং ভারত প্রভাবিত আফগানিস্তান। এসব দেশ ভারতের প্রস্তাবিত উপ আঞ্চালিক জোটের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই উপ-আঞ্চলিক জোটে পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পাকিস্তানের প্রভাব খর্ব করতে চেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, উপ-আঞ্চলিক জোট গঠিত ও কার্যকর হলে সার্কের অপমৃত্যু ঘটবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সার্কের অপমৃত্যু ঘটানোয় পরোক্ষভাবে হলেও সা¤্রাজ্যবাদী ভারতের সহযোগী হয়েছে সার্কের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দৃঢ় থাকলে ভারতের এ পরিকল্পনা সফল হতে পারতো না।
আবারো বলা হচ্ছে, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ভ-ুল করা ছাড়া ভারতের নোংরা কূটনৈতিক লড়াইয়ে আপাতত আর কোনো সাফল্য নেই। বরং দেখা যায়, উরির ঘটনার ইস্যুতে ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের মদদ ও আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র হিসেবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করার যে উদ্যোগ জাতিসংঘের সর্বশেষ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনের সময় নিয়েছিল তা কার্যত ভেস্তে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশ উরি ইস্যুতে পাকিস্তানের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। মার্কিন সরকারের ভাষ্য হলো, উরির সহিংস ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এ সম্পর্কে ভারত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি। অন্যদিকে গ্রেট ব্রিটেন পাকিস্তানের নিন্দা না জানিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারত পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করার উদ্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রণহুংকার দিতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে পরীক্ষিত বন্ধু দেশ চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। সব ধরনের সামরিক সহায়তা দানের আশ্বাসের পাশাপাশি কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি দৃঢ় সমর্থনের কথা ঘোষণা করে চীন। শুধু চীন নয়, ভারত কর্তৃক পাকিস্তান আক্রান্ত হলে সব ধরনের সামরিক সহায়তা নিয়ে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয় ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক। বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব ও ইরান একযোগে পাকিস্তানকে সমর্থন জানায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে আসা ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানের নিরাপত্তার সাথে ইরানের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত। এদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসি পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানায়।
যা হোক, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনে ব্যর্থ হওয়ার পর মোদি এই অক্টোবরে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনকে বেছে নেয় পাকিস্তানকে আবারো একঘরে করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু এখানেও ভারত সফলকাম হতে ব্যর্থ হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, জয়েশ্-ই-মুহম্মদ ও লস্কর-ই-তাইয়োবার দোহাই দিয়ে ভারত গোয়ার ব্রিকস সম্মেলনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ঘোষণা আশা করেছিল চীনের দৃঢ় অবস্থানের কারণে তা ভ-ুল হয়ে যায়। চীনের এ বিরোধিতা আগে থেকেই ছিল। তাই বিকল্প হিসেবে পুরাতন ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত সমর্থন আশা করেছিল। এখানেও ভারতকে নিরাশ হতে হয়। ভারতকে হতাশার সমুদ্রে ডুবিয়ে রাশিয়া এ ব্যাপারে নীরব থেকে মূলত চীনের সিদ্ধান্ত ও অবস্থানকেই সমর্থন করে। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার কাছে ভারতের চাইতে চীনের গুরুত্ব বেশি হয়ে উঠেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশলগত পার্টনার ভারতের দিক হতে রাশিয়া ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি, পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট মতেÑ পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে সীমান্ত পারের সন্ত্রাসকে গোয়ার অ্যাকশান প্ল্যানে আনার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে ছিল ভারত। কিন্তু এ ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার সহমত আদায় করা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই সন্ত্রাস প্রসঙ্গে আইএস বা সিরিয়ার জিহাদী সংগঠন আল নুসরার নাম ঘোষণাপত্রে ঠাঁই পেলেও পাকিস্তানী সংগঠন জইশ বা লস্করের নাম উল্লেখিত হয়নি সেখানে।
এমনকি বর্তমান সময়ে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নীরবতা পালন করে। ব্রিকস সম্মেলনের এক পর্যায়ে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো গ্রেট ব্রিটেনও মোদির সাথে সুর মেলাতে রাজি হয়নি। ব্রিটেন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের মদদ ও আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে চিত্রিত করার পরিবর্তে উল্টো জানিয়ে দেয় সন্ত্রাস মোকাবেলায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে পাকিস্তান। এক কথায় ব্রিকস সম্মেলনে পাকিস্তানকে একঘরে করার মোদি সরকারের যাবতীয় প্রয়াসই ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশসহ বেশ কিছু রাজ্যে বিধান সভা নির্বাচনে ভারতের জনগণের কাছে বীরত্ব জাহির করার জন্য মোদি সরকার এবং ভারতের সামরিক বাহিনীর তরফ হতে এই অক্টোবরে জানানো হয় পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে ভারতীয় সেনারা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামে সামরিক অভিযান চালিয়ে ৫ পাকিস্তানী সৈন্যসহ ৩৫ জন কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী (স্বাধীনতাকামী)কে হত্যা করে নিরাপদে ফিরে এসেছে।
ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতেও সময় লাগেনি। পাকিস্তান জানায়, লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে পাকিস্তান ও ভারতের সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এতে দু’জন পাকিস্তানী সেনা শহীদ হন। পাকিস্তানী মিডিয়া শহীদ দুই সেনার ছবিসহ পরিচয় এবং তাদের নামাজে জানাজার দৃশ্য প্রচার করে। অন্যদিকে ইউটিউবে প্রচারিত এক ভিডিও ক্লিপের তথ্য মতে, পাকিস্তান সৈন্যরা পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতের ৩টি সামরিক চৌকি ধ্বংস, ৩৮ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা এবং অসংখ্য জনকে আহত করে। এসব নিহত সৈন্যের স্থির ও ভিডিওচিত্র পাকিস্তানী মিডিয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখানো হয়। অথচ, ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কোনো বাস্তব চিত্র উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। সর্বোপরি ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। সব থেকে বড় কথা হলো দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরি ওয়াল থেকে শুরু করে কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য বিরোধী দল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নাটক ব্যর্থ হওয়ায় মোদি সরকার বেশ বিপাকে পড়েছে। সত্যি বলতে কি, ভারতের সেনাবাহিনীর সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্র অনেক বেশি থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। যে কারণে কথা উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ সেনাশক্তি গড়তে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে তুঙ্গে উঠেছিল। সে সময় সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) অশোক শর্মা এক টুইটার বার্তায় লিখেছেন, বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ যুবক সৈনিক হবার অযোগ্য এবং বিপরীতে পাকিস্তানের কম করে হলেও ৫০ শতাংশ যুবক সৈনিক হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যে কারণে পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনার সময় অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ৪০ হাজার ভারতীয় সৈনিক ছুটির জন্য আবেদনপত্র দাখিল করেছিল।
তাছাড়া ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে এবং পাকিস্তান পাল্টা আঘাত হানলে কাশ্মীরের আজাদীর লড়াই আরো জোরদার হওয়ার সাথে সাথে উত্তর-পূর্ব ভারত ও খালিস্তানে স্বাধীনতার সংগ্রামও শুরু হয়ে যেত। মাওবাদীদেরও সশস্ত্র লড়াই আরো জোরদার হতো। উল্লেখ্য, পাক-ভারত যুদ্ধ উত্তেজনার সময় শিখনেতা অমরজিৎ সিং ভারত থেকে সংশ্লিষ্ট পাঞ্জাবকে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানের কূটনৈতিক সাহায্য চেয়েছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে এটিই প্রমাণিত হলো যে, ভারতের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি কতটা দুর্বল ও ভঙ্গুর। আরো অনেক বাস্তব কারণের সাথে এ কারণেও ভারত পাকিস্তানের সাথে আরো একটি যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়নি। যা হোক, সবশেষে এ কথা বলা চলে যে, সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতের শুধু কূটনৈতিক নয়, এক ধরনের সামরিক পরাজয়ও ঘটেছে। পাকিস্তানকে একঘরে করার প্রয়াসের ব্যর্থতাকে ভারতের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয়Ñ বলতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
jamil201312@live.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সাইদুল আলম ১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:২৪ পিএম says : 0
পড়ে অনেক জানতে ও শিখতে পাড়লাম। তথ্য সম্বৃদ্ধ লিখার জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন