কাজাখস্তানে গণবিক্ষোভ সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ কোন সতর্কীকরণ ছাড়াই সৈন্যদের গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে, গতকাল মস্কোর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাশিয়ান সৈন্যরা কাজাখস্তানের আলমাতিতে বিমানবন্দরটির ‘পুরো নিয়ন্ত্রণে’ নিয়ে এসেছে।
হঠাৎ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ছয়দিন আগে এই বিক্ষোভ শুরু হলেও এখন কাজাখস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে তা এক গণবিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। গতকাল টেলিভিশনে এক ভাষণে তোকায়েভ বলছেন, কাজাখস্তানের পরিস্থিতি মূলত নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু, তার ভাষায়, সন্ত্রাসীদের দেখামাত্রই গুলি করা হবে। তোকায়েভ বলেন, কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাটির ওপর ২০ হাজার ‘গুÐা’ হামলা চালিয়েছে। যারা আত্মসমর্পণ করবে না, তাদের সবাইকে নির্মূল করার প্রতিশ্রæতি দেন তিনি। টেলিভিশনের ঐ ভাষণে সঙ্কট সমাধানে বিক্ষোভকারীদের সাথে আলোচনা দাবিকে তোকায়েভ ‘হাস্যকর’ বলে বর্ণনা করেন। ‘খুনি ও অপরাধীদের সাথে আলোচনার কী আছে?’ বলেন তিনি, ‘আমরা দেশি-বিদেশি সশস্ত্র অপরাধীদের মোকাবেলা করেছি। আরও স্পষ্ট করে বললে সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করেছি। তাই এদের আমরা ধ্বংস করবো। আর এটা হবে খুব শিগগীরই।’ তবে সে দেশে সন্ত্রাস হয়েছে বলে তোকায়েভ যে দাবি করছেন, বিরোধীদলগুলো তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আলমাতি, কাজাখস্তানের বৃহত্তম শহর এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র, এখন দাঙ্গার মধ্যে রয়েছে, যার মধ্যে সরকারী ভবনে অগ্নিসংযোগ রয়েছে। তোকায়েভ বলেছেন যে, আলমাটিতে ‘আক্রমণের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, কর্মের সমন্বয় এবং উচ্চ যুদ্ধের প্রস্তুতি’ সহ ’২০ হাজার দস্যু’ আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। দেশটির অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় শুক্রবার বলেছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী দেশের সমস্ত অঞ্চলকে ‘বর্ধিত সুরক্ষার অধীনে’ নিয়েছে এবং এই অস্থিরতায় ২৬ জন ‘সশস্ত্র অপরাধী’ নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়েছে। কাজাখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ২ হাজার ২৯৮ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে, ইন্টারফ্যাক্স নিউজ এজেন্সি অনুসারে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ বলেছেন, রুশ সৈন্যরা তাদের কাজাখ সমকক্ষদের সাথে আলমাতি বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীরা এই সপ্তাহের শুরুতে সকল ট্রান্সপোর্ট হাব দখল করলে বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ বিক্ষোভ দমনে সাহায্য চাওয়ার পর রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রে সেনা মোতায়েন করে। মস্কো-অধ্যুষিত যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির (কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিএসটিও) আওতায় অস্থিরতা দমনে সাহায্য করার জন্য কাজাখস্তানে সৈন্য পাঠানোর পর তোকায়েভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন।
বিদেশি এই বাহিনী কাজাখস্তানে প্রায় আড়াই হাজার সেনা পাঠিয়েছে। সিএসটিও জানিয়েছে, তাদের সেনারা শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং তারা রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা দেবে। রুশ বার্তা সংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, এই বাহিনী কাজাখস্তানে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রুশ বাহিনী মোতায়েনের অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করছে তারা। এক মুখপাত্র বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং খোলাখুলিভাবে পুরো দুনিয়া দেখবে সেখানে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় কিনা।’ এছাড়া কোনও কাজাখ প্রতিষ্ঠান দখলও হয়ে যাচ্ছে কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানান তিনি।
কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিএসটিও কি: ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের তেল সমৃদ্ধ দেশ কাজাখস্তানে যখন নতুন বছরের শুরুর দিনগুলোতে ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ জানতেন কাকে ডাকতে হবে। ৬ জানুয়ারি তিনি কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনে (সমষ্টিগত নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা বা সিএসটিও) ফোন করেছিলেন। কয়েক ঘন্টার মধ্যে, রাশিয়ান প্যারাট্রুপার এবং বেলারুশিয়ান বিশেষ বাহিনী আলমাটির উদ্দেশ্যে বিমানে উঠছিল, তারা টোকায়েভকে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এরপর থেকেই নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছে সিএসটিও। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে, মার্কিন জোট ন্যাটোর জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জোট ওয়ারশ চুক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এক বছরেরও কম সময় পরে রাশিয়া এবং কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস এর পাঁচটি মিত্র রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি নতুন যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ১৯৯৪ সালে কার্যকর হয়েছিল।
এটি ওয়ারশ চুক্তির চেয়ে ছোট, দুর্বল এবং কম উচ্চাভিলাষী ছিল। এবং সে সময় সঙ্কটে থাকা রাশিয়ান শক্তির সাথে, দলটি বহু বছর ধরে মোটামুটি নীরব ছিল। কিন্তু ২০০২ সালে, মধ্য এশিয়ার ভ‚-রাজনীতি যখন বড় আকার ধারণ করেছিল-আমেরিকা আগের বছর আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল- সে সময় তারা নিজেদের সম্মিলিত নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা ঘোষণা করেছিল, যা ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক জোট। বর্তমানে এর ছয় সদস্য রয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, রাশিয়া এবং তাজিকিস্তান (২০১২ সালে উজবেকিস্তান চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যায়)। রাশিয়ার জন্য, সিএসটিও হল পশ্চিমা এবং চীনা উভয়ের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মধ্য এশিয়ার উপর তাদের প্রভাব বিস্তারের একটি কার্যকর হাতিয়ার। এটি সদস্য দেশগুলোতে রাশিয়ান সামরিক সুবিধাগুলোকে ন্যায্যতা দেয়, পাশাপাশি এই অঞ্চলে অন্য কোনও বিদেশী ঘাঁটি স্থাপণে রাশিয়াকে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা দেয়। পরিবর্তে সিএসটিও এর সদস্যরা রাশিয়ার উন্নত সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে উপকৃত হয়, যার মধ্যে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র বিক্রির উপরে ছাড় রয়েছে।
গত এক দশকে, সিএসটিও-এর উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়েছে। ২০০৭ সালে তারা একটি ৩ হাজার ৬০০ সদস্যের একটি শক্তিশালী শান্তিরক্ষী বাহিনী তৈরি করতে সম্মত হয় এবং দুই বছর পরে তারা দ্রæত প্রতিক্রিয়া বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে যা দাবি করে যে, ২০ হাজার প্রশিক্ষিত সেনাকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। কাছাকাছি আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে গত গ্রীষ্মে এবং শরৎকালে হাই-প্রোফাইল ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ মহড়ার একটি সিরিজ সহ জোটটি একাধিক যৌথ মহড়াও করেছে।
যদিও এই সপ্তাহ পর্যন্ত, কোনো সিএসটিও সদস্য তার চুক্তির অনুচ্ছেদ ৪ আহŸান করেনি। এটি একটি পারস্পরিক-প্রতিরক্ষা ধারা যা ন্যাটোর সুপরিচিত ধারা ৫-এর অনুরূপ। তবে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান, যিনি সিএসটিওর বর্তমান সভাপতি, বলেছেন যে, দলটি শান্তিরক্ষী পাঠাতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়া এবং বেলারুশ ছাড়াও, তাজিকিস্তান এবং আর্মেনিয়াও পরিমিত দল পাঠাতে সম্মত হয়েছে। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি নিউজ, রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন