মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। উঁচুনিচু পাহাড়, লেক-স্বচ্ছ পানির ধারা। ঘনসবুজে ঘেরা বন-বনানী। এমন মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক পরিবেশ। অথচ প্রকৃতিপ্রেমীদের টানতে পারছে না। চট্টগ্রামের ইকোপার্কগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পর্যটক, দর্শনার্থী। পর্যটন বিকাশে অপার সম্ভাবনা থাকার পরও নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বেহাল সড়ক অবকাঠামো এবং নিরাপত্তাহীনতায় দিনে দিনে বিমুখ হচ্ছেন পর্যটকেরা। এতে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে এসব ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুÐে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক। লোহাগাড়ায় চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আর উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনায় গড়ে উঠেছে শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্ক। এমন ভর মৌসুমে এসব ইকোপার্কে দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদভারে মুখরিত থাকার কথা থাকলেও নেই কাক্সিক্ষত পর্যটক।
করোনার চোখ রাঙ্গানির সাথে এসব ইকোপার্কে অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন পর্যটক, দর্শনার্থীরা। তাদের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এসব বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পর্যটকেরা। ফলে পর্যটকের খরা চলছে দৃষ্টিনন্দন এসব ইকোপার্কে। অথচ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ফলে এ চারটি ইকোপার্ক হয়ে উঠতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। আর তাতে পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতিও আরও সুদৃঢ় হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ।
‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ সীতাকুÐের পাহাড়ে এসে মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত এ গানটি রচনা করেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই পাহাড় ঘিরেই গড়ে উঠেছে সীতাকুÐ বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। তবে পর্যটকদের মুগ্ধ করার মত তেমন কিছু নেই এ পার্কে। পর্যটক আকর্ষণে প্রাকৃতিক ঝর্ণাসহ বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি পার্কও গড়ে তোলা হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে এসব স্থাপনা দিনে দিনে মলিন হয়ে পড়ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইকোপার্ক উঠার সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা।
সবুজ পাহাড়, ঝর্ণা দেখতে আসেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। কিন্তু অবহেলিত এ পার্কে দীর্ঘদিন ধরে তেমন কোন অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি। ভাঙ্গাচোরা সড়কে চলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। ছিনতাইকারীর কবলেও পড়ছেন অনেকে। জানা গেছে, ৪৯ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ফাইল বন্দি হয়ে আছে। এ পার্কের আয়তন ২০০০ একর। অপরদিকে পার্কের ইজারাদার জানিয়েছেন করোনাকালীন সময়ে এখন পার্কে তেমন পর্যটক আসছে না। ফলে লোকসান গুনছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজ কান্দির পাড় কুমিল্লা থেকে আসা কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য এডভোকেট শাহাজান সিরাজ বলেন, এখানে একসাথে সমুদ্র ও নাম জানা অজানা অসংখ্য প্রকার বৃক্ষরাজি, বাতাবাহার, গোলাপ বাগান, অর্কিড হাউজ, ঔষধি গাছ, নির্জন সবুজ পাহাড়ের মাঝে ঝর্ণা বিরামহীন ঝরে পড়া সবকিছুই উপভোগ করা যায়। তবে পার্কের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া দরকার। সহস্রধারা ঝর্ণা ও সুপ্তধারা ঝর্ণায় যাওয়ার সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। গাড়ি চলাচল তো দূরের কথা হেঁটে যাওয়ার মত অবস্থাও নেই। দীর্ঘ পাহাড়ে উঠতে পর্যটকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা।
ইকোপার্কের ইজারাদার মো. নাজমুল হাসান পিন্টু বলেন, পার্কে বর্তমানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এখানে আগের মত ছিনতাই হয় না। পর্যটকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সপরিবারে ঘুরতে পারছেন। ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের রেঞ্জার মো. আলমগীর বলেন, পার্কে নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হয়েছে। আমাদের কর্মীরাও সারাক্ষণ পার্কে সক্রিয় রয়েছেন। সন্ধ্যার পর পার্কে থাকা এবং ঘোরারাফেরা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটকরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এ ইকোপার্কের কাছেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন গুলিয়াখালী সৈকত। সরকার ওই সৈকতকে বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। সীতাকুÐ ইকোপার্কে ঘুরতে আসা পর্যটকরা গুলিয়াখালীতেও ঘুরে বেড়ান। সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে পাশাপাশি দুটি পর্যটনকেন্দ্রকে ঘিরে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।
বাঁশখালী ইকোপার্কেরও বেহাল অবস্থা। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ২০০৩ সালে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, ইকো-ট্যুরিজম ও চিত্তবিনোদনের উদ্দেশে প্রায় এক হাজার হেক্টর বনভ‚মি নিয়ে সরকারি উদ্যোগে এ ইকোপার্কটি নির্মাণ করা হয়। প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে এ ইকোপার্কের সৌন্দর্যও পরিবর্তিত হতে থাকে। সে হিসেবে সারা বছরই এখানে দর্শনার্থী, পর্যটকের ভিড় থাকার কথা। কিন্তু কাক্সিক্ষত পর্যটক মিলছে না। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরবর্তী এ ইকোপার্কে যেতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। ইকোপার্কের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেহাল। এর ফলে পর্যটকরা ইকোপার্কমুখী হচ্ছেনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত এ পার্কের ৬৭৪ হেক্টর বনভ‚মিতে ঝাউ বাগান, ভেষজ উদ্ভিদের বন, ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। রয়েছে পিকনিক স্পট, রেস্ট হাউস, হিলটপ কটেজ, দীর্ঘতম ঝুলন্ত ব্রিজ, ওয়াচ টাওয়ার এবং মিনি চিড়িয়াখানা। পার্কের দু’টি সুবিশাল লেকে রয়েছে মাছ ধরার ব্যবস্থাও। এতসব মনোমুগ্ধকর আয়োজনেও প্রায় ফাঁক থাকছে ইকোপার্কটি।
রাঙ্গুনিয়ার শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্কে নানা বিড়ম্বনার শিকার পর্যটকেরা। ভর মৌসুমেও তাই পর্যটকের খরা। সবুজ পাহাড়বেষ্টিত রাঙ্গুনিয়া বন রেঞ্জের কোদালা বিটের দক্ষিণ নিশ্চিন্তাপুর বনাঞ্চলে ২১০ হেক্টর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে ইকোপার্কটি। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশে চন্দ্রঘোনা সেগুনবাগানের কাছে এর প্রবেশদ্বার। প্রবেশমুখেই সারিবদ্ধ মিনি খাঁচায় বন্দি হরেক রকমের পাখি। কৃত্রিম লেকে দেশি-বিদেশি হাঁস ও পাখির বিচরণ। সবুজ বনে উড়ছে মুক্ত পাখ-পাখালি। ছোট-বড় লেক, বনাঞ্চলে নানান ফল-ফসলে পাখিদের ঘুরে বেড়ানোর বিরল দৃশ্য অবলোকন করা যায় এ পার্কে। পার্কে রয়েছে রোপওয়ে, তাতে চলে ক্যাবল কার। এসব কারে চড়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও অর্জন করা যায় সেখানে। আছে নিভৃতে পাহাড়ের ছাউনিতে বসে পাখি দর্শনের সুযোগ। আছে পিকনিক স্পট, শিক্ষা সফরেরও ব্যবস্থা। নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটক মিলছেনা। শিক্ষা সফর এবং তরুণদের দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া তেমন পর্যটক নেই এ পার্কে। তবে পার্কের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারীতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটকরা আসছেন।
চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি রয়েছে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এটি এশিয়ান হাতি প্রজনন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মহাদেশীয় জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাÐার। প্রায় ৭ হাজার ৭৬৬ হেক্টর বনভ‚মি নিয়ে এ অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। হাতি, বানর, বন্য শুকর, সাম্বার, মায়া হরিণ, হনুমান ছাড়াও এখানে রয়েছে ৪ প্রজাতির উভয়চর, ৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৫৩ প্রজাতির পাখ-পাখালি। আছে ১০৭ প্রজাতির বৃক্ষরাজি। পর্যটকদের জন্য সেখানে আছে বনপুকুর, গয়ালমারা প্রাকৃতিক হ্রদ, গোলঘর, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ন্যাচার কনজারভেশন সেন্টার, ইকো কটেজ। আছে প্রশিক্ষিত ট্যুর গাইড। এ অভয়ারণ্যে বন্য পশু-পাখির পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন বন-বনানী দেখার অনন্য সুযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন