রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদের সচেতন হতে হবে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

দেশী এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০৮০ সাল নাগাদ সমুদ্রতল ৯ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং কার্বন নির্গমনের উচ্চহারে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তার ফলে সমুদ্রতল ১৬ থেকে ৬৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। ২০৮০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ভ‚মির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে নিমজ্জিত হবে। এর ফলে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোর মনুষ বাস্তুভিটা হারাবে। নদ-নদীতে লোনা পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, বাড়বে শরণার্থীর সংখ্যা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে এবং দেশে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে, হেপাটাইটিস-বি, সংক্রামক ব্যাধি, মেনিনজাইটির মতো গ্রীষ্মকালীন রোগ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে স‚র্যের বিকিরণকৃত আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে ত্বক ক্যান্সার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এটা শংকারই কথা।

বন্যার জন্য ঝুঁকিপ‚র্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভ‚-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান নদনদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এদেশের কৃষিখাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এদেশের প্রধান অর্থকারী ফসল হচ্ছে ধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিনে দিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধানচাষ। অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি এবং প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণেও ধানচাষ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ, পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষিরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন। পাট চাষের ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। শীতকালের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলাসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন।

এটা অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যাপার যে, জলবায়ু আমাদের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে উঠছে। আমাদের আগামী প্রজন্ম একটা সুন্দর পৃথিবী পাক, সেজন্য আমাদের এখনই ভাবতে হবে। আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে ভাবনায় পরে গেছি ঠিক তখনই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের খনি তৈরি হচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে। নির্মাণাধীন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি বলে দিচ্ছে পরিবেশ নিয়ে কতটা সচেতন আমরা। ২০১২ সালের ২৯ জনুয়ারি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ নিয়ে দেশে যথেষ্ট হৈ চৈ হয়েছে। কে শোনে কার কথা। এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এজন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার সন্দেহ নেই। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তাতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এ বিষয়টি আমরা মোটেও বিবেচনায় নিচ্ছি না। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু নিয়মনুসারে পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা তা কি করা হয়েছে? হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দ‚রে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমন্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে এসিড বৃষ্টি হবে। কি পরিমাণ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা এখনি ভেবে দেখা দরকার। গাছপালা মরে যাবে। সুন্দরবন উজাড় হবে। পশু-পাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আজ যেখানে বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলছে সেখানে আমরা এমন অসচেতন হই কি করে?

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোন দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভ‚মি প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে সরকারী হিসাব মতে মাত্র ১৯ শতাংশ বনভ‚মি রয়েছে। আর বেসরকারী হিসেবে এর পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি নেই। বাসগৃহ ও আসবাবপত্র তৈরিতে এবং জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সংগ্রহ করা হয় কাঠ। এ জন্যে ব্যাপকহারে বন উজাড় করা হচ্ছে। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে বৃক্ষের অপরিহার্যতা অসামান্য। বৃক্ষ প্রতিনিয়ত বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। অর্থাৎ গাছের মূল থেকে সংগৃহীত পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড স‚র্যের আলোর উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে অক্সিজেন ও গøুকোজ উৎপন্ন করে। গাছের আর একটি বিশেষ গুণ হল নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করতে পারে। প্রাণী তা পারে না। বরং উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছে। পরিতাপের বিষয় যে, মনুষ এই কল্যাণময় পরিবেশ ও বনভ‚মির উপর অত্যাচার করে চলেছে। নির্বিচারে উজাড় করা হচ্ছে বৃক্ষরাজি। ২০০০ সালে জাতিসংঘের বনজ সম্পদ নিয়ে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আমাদের দেশের সবচেয়ে উন্নত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৪৫০ হেক্টর থেকে ২০০ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বৃক্ষ নিধন চলতে থাকলে পরিবেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহরূপ ধারণ করবে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা এবং এ কারণে অতিমাত্রায় অনাবৃষ্টি ও খরার কবলে পড়তে হচ্ছে।

আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বেড়েছে আরও প্রকটভাবে। পুঁজিবাদী স্বার্থান্বেষী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো করপোরেট সমাজের স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও দ‚ষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে আছে এমন আভাস আমরা অনেক আগেই পেয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে ভুগবে বাংলাদেশসহ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় ভোগান্তির শিকার হবে এসব অঞ্চলের দুই বিলিয়ন মনুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়া ও প‚র্ব এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে খারাপ মৌসুমী আবহাওয়ার মধ্যে পড়বে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোয় অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অদ‚রভবিষ্যতে এর প্রভাব দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু থেকে কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে পড়তে শুরু করবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’ পটভ‚মিতে হিসাব করে দেখিয়েছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা ৪.২ ডিগ্রি বাড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তন এর নেতিবাচক দিক ভেবে মানবসভ্যতা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। আইপিসিসি’র দাবি অনুসারে, বর্তমান সময়টি হলো গত ১০০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ। উন্নত বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে বায়ুদ‚ষণ প্রতিক্রিয়ার ফলে ২০৬০ সালের পরে নন মেলানোমা স্কিন ক্যান্সারের ঘটনা সংখ্যা শতকরা ৬ থেকে ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্র উচ্চতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বৃহৎ শহর ও উপক‚লের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে লাখ লাখ জনসাধারণকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করবে। এটি তৈরি করবে খাদ্য ঘাটতি এবং তার প্রেক্ষিতে কিছু কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা, অন্যান্য বিষাক্ত উৎপাদক, যেমন ফাঙ্গাস থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তার ফলে খাদ্য নষ্ট হওয়ার পরিমাণ সম্ভবত বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চাষাবাদের সময়কাল সঙ্কুচিত হতে পারে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব বনাঞ্চলে পড়লে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে। প্রাণিকূল, ভ‚মি, পানি ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপক‚লীয় নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দুই কোটি মনুষ বাস্তুহারা হবে। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।

পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের দক্ষিণের বিরাট অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর মে-জুন এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সামুদ্রিক ঘ‚র্ণিঝড় আঘাত হানছে। এ দুর্যোগ থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কি? পরিবেশ দ‚ষণ নিজেদের মুক্ত রাখা, বিপন্ন পরিবেশের ব্যাপারে আওয়াজ তোলা, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো উল্লিখিত বিষয়ে অনেক প্রতিশ্রæতি দিলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এসব প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নে শিল্পোন্নত দেশগুলো তেমন আন্তরিক নয়। কোনো কোনো প্রতিশ্রæতি অনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। এবারও বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নানা প্রতিশ্রæতির বাণী দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্মেলনে বাংলাদেশের বিপন্ন পরিবেশ নিয়ে জোরাল বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ব নেতারা এ ব্যাপারে কতটুকু নজর দেবেন, এটাই এখন দেখার বিষয়।
পরিবেশ সচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমাদেরকে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু ও দেশে পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে আরো বেশি সচেষ্ট হতে হবে। কেবল সরকারের পক্ষেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়; জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভ‚মিকা রাখতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন