সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে তারা অনশন ভেঙ্গেছেনআন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকও। এসময় জাফর ইকবাল বলেছেন, সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের বার্তা’ পেয়েই শাবিতে এসেছেন তাঁরা। ‘উচ্চ পর্যায়’ থেকে বলা হয়েছে, সব দাবিদাওয়া ‘পূরণ করা হবে’ শিক্ষার্থীদের।
গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শাবিতে একটি ঘটনার সূত্র ধরের আন্দোলন ধানা বাঁধতে শুরু করে। পরবর্তীতে ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে সেই আন্দোলন উপাচার্যব বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯ জানুয়ারি থেকে অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। শিক্ষামন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ, এমনকি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেও একাংশ চেষ্টা করেও অনশন ভাঙাতে পারেননি শিক্ষার্থীদের। অবশেষে আজ বুধবার (২৬ জানুয়ারি) প্রায় ১৬৩ ঘন্টা পর অনশন ভেঙেছেন শিক্ষার্থীরা। শাবির সাবেক দুই শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিনের হকের চেষ্টায় তারা অনশন ভাঙেন। এ দম্পতি গতকাল রাতে ঢাকা থেকে রওয়ানা দেন। আজ বুধবার ভোরে তাঁরা ক্যাম্পাসে পৌঁছেন। আজ সকালে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙার পর তাঁরাদুজনেই বক্তব্য দেন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি পারমিশন ছাড়া ঢুকে গেছি। কাজেই আমি টেকনিক্যালি স্পিকিং, আমি বহিরাগত।’ তখন তার এ বক্তব্য বিপরীতে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, ক্যাম্পাসটা আমাদের। প্রশাসনের না। ডিসিশান আমাদের হবে।’ জাফর ইকবাল বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের!’ এসময় ইয়াসমনি হক বলেন, ‘ভেবেছিলাম, আজকে সকালে আসবো। কিন্তু তোমরা যারা বসা ছিলে জুম মিটিংয়ে, বলেছিলে আজকেই রওয়ানা হোন। (গতকাল মঙ্গলবার) রাত ৮টা বাজে প্রায় তখন। আমরা তখনই ডিসাইড করে রওয়ানা হয়ে গেছি রাতে।’ এরপর জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি, কারণ আমাকে একদম উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, তোমাদের দাবিদাওয়া পূরণ করা হবে। আমি সেজন্যই এসেছি।’ শিক্ষার্থীরা তখন হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে, তোমাদের সকল দাবিদাওয়া লিখে পৌঁছে দিতে উনাদারকে।’তখন শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘স্যার, আমাদের দাবি একটাই (ভিসির পদত্যাগ)।’ জাফর ইকবাল বলেন, ‘শুধু একটা দাবি না, আরও দাবি আছে।’ এসময় এক মেয়ে শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, এমন মানুষের কাছে আমাদের কুক্ষিগত করে রাখবেন না, যে কথায় কথায় আমাদের ওপর গুলি চালাবে। জাফর ইকবাল তখন খানিকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তোমরা কেন কুক্ষিগত হয়ে থাকবে ? বুঝাও আমাকে? তোমাকে কে বলছে ? ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ক্যাম্পাসে কোনো স্বাধীনতা নাই, স্যার।’ এ পর্যায়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘স্বাধীনতা নাই মানে কী? তোমরা যদি বলো স্বাধীনতা আছে, তাহলে স্বাধীনতা আছে। এটা তোমাদের ক্যাম্পাস।’ তখন এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, আবার যে ওয়াটার ট্যাংক, রায়ট (কার) আসবে না, এটার নিশ্চয়তা নাই স্যার।’ জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘না, আসবে হয়তো। তোমরা ঠেকাবে আরেকবার, যেভাবে ঠেকাইছো। সারা বাংলাদেশের সমস্ত তরুণ প্রজন্ম তোমাদের পেছনে। সমস্ত মানুষজন তোমাদের পেছনে। তোমরা সুস্থ হও। উদাহরণ তৈরি করো। যে উদাহরণ বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে উদাহরণ অনুসরণ করবে।’ তারপর অধ্যাপক ইয়াসমিন হক বলেন, ‘আমাদেরকে যদি উপরের মহল থেকে একদম আশ্বাস দেওয়া না হতো যে, তোমাদের সব দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হবে, আমরা কী আসি ?’
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা কোন মুখে আসতাম ?’ তৎক্ষণাত ইয়াসমিন হক বলেন, ‘না, আসতাম! এসে বলতাম, নিজে নিজে এসে গেছি! তাই না ?’ পরে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো যে, তোমরা অনশন ভেঙেছো। এখন তোমাদেরকে হাসপাতালে যেতে হবে, তোমাদেরকে রিকভার করতে হবে।’ এরপর ইয়াসমিন হক জানান, গত ১৬ জানুয়ারি পুলিশ শিক্ষার্থী-সংঘর্ষে ঘটনায় ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে এবং শাবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তা ‘ড্রপ করা হবে’ বলে ‘উপর মহল থেকে জানানো হয়েছে’। তখন হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমরা নিজেরা নেতৃত্ব দিয়েছে, এতো সুন্দর একটা আন্দোলন করেছো, সারা দেশের মধ্যে উদাহরণ তৈরি করেছো।’ শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর পর সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন জাফর ইকবাল দম্পতি। এসময় ইয়াসমিন হক বলেন, ‘এদের অনশনে একেক ঘন্টা এদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খুবই ভালো লাগছে, ওরা (শিক্ষার্থী) কথাটা শুনেছে, আমাদের কথাটা রেখেছে। এতোজন, ২৭ জন আমার মনে হয় আজকে ছিল, এরা অনশন ভেঙেছে। আমাদের জন্য এটা সবচেয়ে বড় পাওনা। আমরা তো এখন নাই এখানটায় (শাবিতে), তিন বছর, প্রায় আড়াই-তিন বছর হতে চললো আমরা নাই এখানে।’ তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। স্যারও বলেছেন, থ্যাংক ইউ। আসলে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবো না।’ শিক্ষার্থীরা ‘দানব’ বলেছেন উপাচার্যকে। সেই ‘দানবের’ কাছে শিক্ষার্থীদের রেখে যাচ্ছেন আপনারা। এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন ? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াসমিন হক বলেন, ‘না, না, এটা তো আমাদের ডিসিশন না...’। তাঁর কথা কেড়ে নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘শুনেন, ছাত্রদেরকে আন্ডারএস্টিমেট করবেন না। কে, কাকে, কার কাছে রেখে যাচ্ছি, সেটা সময়েই বলে দেবে।’ পরে ভিসির পদত্যাগ বা অপসারণ সংক্রান্ত দাবির প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি যখন বলেছি যে, তারা (সরকার) দাবিদাওয়া মেনে নেবেন বলেছেন, তখন দাবির মধ্যে এই দাবিটাও তো পড়ে। কিন্তু সরকারেরও তো নিজস্ব টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে, ব্যাপার থাকে রাজনৈতিক, সেটার জন্য হয়তো একটা প্রসেস থাকে তাদের। গোপালগঞ্জের ভাইস চ্যান্সেলরকে তারা একভাবে সরিয়েছে, অন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে অন্যভাবে সরিয়েছে। কাজেই সেটা তাদের ব্যাপার। আমার প্রাইমারি কনসার্ন ছিল, ওদেরকে অনশন থেকে বের করতে পারি কিনা।’
এসময় ইয়াসমিন হক বলেন, ‘আমার মনে হয়, যা যা হয়েছে, এটা দেখি আমরা, ওয়াচ করি।’ আন্দোলনে বহিরাগতদের কোনো ইন্ধন ছিল বা আছে কিনা, এরকম এক প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘ এই ছেলেদের দেখে মুগ্ধ আমি। ওরা যতো সুন্দরভাবে ম্যানেজ করেছে..এই ধরনের একটা আন্দোলন, যেটা হয়েছে, আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দল এরকম একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। যেখানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা প্রায় তরুণ-তরুণী হার্ট দিয়ে যেটা অনুভব করবে। এই আন্দোলন যখন হয়, তখন সেই ফায়দা নেওয়ার জন্য সবসময় অন্যরা ভেতরে ঢুকে চেষ্টা করে লিডারশিপটা নেওয়ার। এরা কিন্তু সেটা করতে দেয় নাই। আমি দেখেছি যে, এরা সাধারণ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে নাই কোনো উচ্চভিলাষ। পুলিশ ওদের গায়ে এরকম নির্মমভাবে হাত তুলেছে, কাজেই ওদের মনের ভেতর একটা ক্ষোভ হয়েছে, সংঘত কারণেই। সেজন্যই তারা এই আন্দোলনটা করছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নাই, অহেতুক কোনো দাবি নাই। ওদের দাবি শতভাগ যৌক্তিক দাবি।’ইয়াসমিন হক বলেন, ‘বহিরাগত যেটা বলছেন, এইগুলা সব হলো, এখানে আসার পর এক ছাত্রী বললো, স্যার, ম্যাডাম, এটা আমাদের তিন বছরের ক্ষোভ। সব এখন বের হয়ে আসছে।’ জাফর ইকবাল যোগ করেন, ‘আমি তিন বছর আগে যখন নাকি অবসরে চলে যাই, তখন একটা চিঠি লিখে উনাকে (ভিসি) দিয়ে যাই। সেই চিঠিতে আমি বলে দিয়েছিলাম অনেকগুলি। আমি সেখানে লিখেছিলাম স্পষ্ট করে, আপনি যদি এগুলো না করেন, ছাত্রদের এখন যে ক্ষোভ আছে, বিক্ষোভে রূপ নেবে তার। একদম অক্ষরে অক্ষরে আমার কথাটা ফলেছে।’ পুলিশি হামলার সময় শিক্ষকদের নিরব থাকা ও প্রতিবাদ না করা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক....যখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন টিচার্সদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল যে, খবরদার! তোমরা এটা করতে পারবা না। একজন টিচারও সেটা করেননি।’ ‘একজন শিক্ষকের এরকম মেরুদন্ডহীন হওয়ার কোনো কারণ নাই’ বলেও মন্তব্য করেন জাফর ইকবাল। পুলিশি হামলার ঘটনায় ইয়াসমিন হক ‘একদম শকড’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, কখন এটা কাটিয়ে ওঠবো।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে টং দোকান, রোড পেইন্টিং, নাটক, কনসার্ট বন্ধ বলে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা এটাকে ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ বলে অভিহিত করে এটাকে ‘তালেবানি সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে জাফর ইকবাল দম্পতি কী ভাবছেন ? এমন প্রশ্নে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা তো অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কাজগুলো (বন্ধ) হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেংথ ছিল, আমাদের এমন কোনো সংগঠন নাই যেটা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। কার্টুন আঁকার সংগঠন থেকে শুর করে, সায়েন্সের, নাটকের, ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে এমন কোনো সংগঠন নাই, যেটা ছিল না।’ তিনি যোগ করেন, ‘সেটা যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখনই বোঝা গেছে, এই মানুষটা (ভিসি) আর যাই হোক, একাডেমি বুঝেন না উনি। ’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন