মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
ধূর্ত ও কৌশলী পকেটমার তার পাশের ভালো মানুষটিকেও পকেটমার সাজিয়ে কেটে পড়তে পারে অনায়াশেই। এতে নিরপরাধ মানুষটি গণপিটুনির শিকার হওয়ার জন্য তার কোনো অনুশোচনা বা অপরাধ বোধ তো জাগেই না, বরং দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ও গর্বই অনুভব করে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এরই নাম ‘ডিপ্লোমেসি’। আর এ কাজে সফল ব্যক্তিকে পশ্চিমা রাষ্ট্রদর্শন ও মূল্যবোধ অপরাধী তো নয়ই বরং ঝানু কূটনীতিক হিসেবে প্রশংসায় থাকে পঞ্চমুখ। বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায় এমন একটি জটিল ও কুটিল কূটনীতি বা ডিপ্লোমেসির শিকার। অবস্থা যতই নাজুক ও উদ্বেগজনক হোক বোবাকান্না ছাড়া মুখ খুলে তা প্রকাশ করার সুযোগও তাদের নেই এখন।
৩য় ক্রুসেড পর্যন্ত সব কয়টি ক্রুসেডের গড় ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে হলেও বুশ ঘোষিত চলমান ৪র্থ ক্রুসেডের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে আসার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত একেবারেই ক্ষীণ। কারণ এটি এমন এক অদৃশ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত যুদ্ধ যে বিষয়ে মুসলমানরা বিলকুল বেখেয়াল। ৪র্থ ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছিলেন বুশ কিন্তু সমাপ্তির ঘোষণা দেননি ওবামাও। অতএব, ধরে নিতে হবে ৪র্থ ক্রুসেড চলছে তার মতোই। আর ট্রাম্প যদি জিতেই যান তবে এ যুদ্ধ হয়ে উঠবে আরো ভয়ঙ্কর। এতে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো অভিনবই নয় শুধু, লক্ষ্য ভেদে অনন্যও। এই যেমন ‘আইএস’! ওদের কোন কাজটা ইসলাম সম্মত? ওদের হাতে যারা খুন হয়েছেন তাদের প্রায় শতভাগই মুসলমান। তাদের টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে টুকরো টুকরো করে মহল্লায় মহল্লায় পরস্পর বৈরী আমির-বাদশা সৃষ্টির ইহুদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, যার পৃষ্ঠপোষক খোদ আমেরিকাও। ভুঁইফোড় ‘আইএস’ সকলের কমন শত্রু হলে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের উৎস কী? তাদের ভাষায় ‘বিশ্ববিধ্বংসী মারণাস্ত্রের অধিকারী’ সাদ্দাম নিপাতে তিন দিনের যুদ্ধই যথেষ্ট হলে তিন বছরেও ‘আইএস’ দমনের কূলকিনারা না হওয়ার রহস্য কোথায়? ‘আইএস’ যে তেলআবিব আর ওয়াশিংটনের একটা ‘যৌথ প্রজেক্ট’ রিয়াদ বোঝেছে তা তিন বছরে, অন্যদের তো খবরই নেই কী হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। তেলের দাম কমেছে ৭৫ ভাগ। আর আরবদের খেদমতে অস্ত্রের মূল্য বেড়েছে নাকি ক্ষেত্রবিশেষে তিনগুণ! মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে শিকারি বাজ উড়বে না তো উড়বে কী শান্তির পায়রা?
মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি আর স্বৈরতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা চলমান ক্রুসেডের আর একটি বহুল ব্যবহৃত ভয়ঙ্কর অস্ত্র, যার শিকার বাংলাদেশ, মিসর, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, তুরস্কসহ অনেকেই। একদিকে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না, অন্যদিকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছোরা হাতে কসাই। গণতন্ত্রের অবর্তমানে স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ অপরিহার্য। হানাহানি, বিশৃঙ্খলা ও অপশাসন স্বৈরতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। চোখ মেলে তাকালেই দেখা যাবে মুসলিম বিশ্বে যেখানেই স্বৈরশাসক সেখানেই ক্রুসেডাররা পৃষ্ঠপোষক।
ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও অপসংস্কৃতির ভয়াবহ আগ্রাসনের পাশাপাশি তথ্যসন্ত্রাস ৪র্থ ক্রুসেডে ব্যাপক ব্যবহৃত এক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। যখন যাকে খুশি ঘায়েল করার জন্য এখানে ইচ্ছাটাই যথেষ্ট। ফলে ‘মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী’ আর ‘ইসলাম হলো সন্ত্রাসের প্রেরণা ও উৎস’ এমন একটি ধারণা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়াতেই তাদের সাফল্য নয় শুধু, বরং খোদ মুসলমানদের মাঝেও এমন একটা সংশয়ের বীজ রোপণে তারা কৃতিত্বের অধিকারীও বটে। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন মডেলের ‘আলকায়দা’ আর ‘আইএস’ জন্ম নিচ্ছে আজ ঘরে ঘরে। প্রতিপক্ষকে বশে রাখার জন্য অজ্ঞ ও মূর্খ করে রাখার মতো কৌশল আর নেই। আইএস, আলকায়দা, জেএমবি যে এই মূর্খতারই ফসল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ। ইসলামের নামে জীবন উৎসর্গে মরিয়া সন্ত্রাসীদের প্রায় শতভাগই কথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও প্রকৃত ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও মূর্খ। এরা জানেই না জিহাদ কী ও কেন এবং কীভাবে। আইএস, আলকায়দা এদের কোন কাজটা ইসলাম সম্মত? মুসলমানদের জীবন সম্পদ বিনষ্ট ও ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ দুশমনিতে নিয়োজিত থাকার পরও তথ্য সন্ত্রাসীদের কূট প্রচারণায় এরা ‘ইসলামের সৈনিক’, ‘জঙ্গি’ আর ‘জিহাদী’! সন্দেহ নেই, জিহাদ ইসলামের এক অপরিহার্য মৌলিক দর্শন, যা মজলুম মানবতার মুক্তির সোপান ও রক্ষাকবজ বিশেষ। এ প্রসঙ্গে পাক কোরআনের আহ্বানÑ ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে, অসহায় নির্যাতিত নর-নারী ও শিশুদের পক্ষে? যারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের প্রতিপালক, এই জালিম অধ্যুষিত জনপদ হতে আমাদেরকে উদ্ধার করে নাও, তোমার পক্ষ হতে কাউকে আমাদের জন্য অভিভাবক করে পাঠাও, আর আমাদের জন্য প্রেরণ কর সাহায্যকারী’ (নিসা-৭৫)।
আল কোরআনের অন্যত্র বলা হচ্ছে, ‘অন্যায়ভাবে যে একজন মানুষকে হত্যা করল; সে যেন সমগ্র মানবতাকেই হত্যা করল। আর যে একটি জীবন বাঁচাল সে যেন সমগ্র মানব জাতিকেই রক্ষা করল।’ তাহলে হুজি, আলকায়দা বা আইএসের কর্মকা-ের সাথে ইসলামের সম্পর্ক বা মিল কোথায়? হ্যাঁ রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘অত্যাচারী শাসকের মুখের ওপর সত্য বলাটাই সর্বোত্তম জিহাদ।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘জালেমকে হাত দিয়ে প্রতিহত কর, তা না পারলে মুখে প্রতিবাদ কর, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দিয়ে হলেও।’ চিন্তার বিষয় এতে করে শান্তি ও মানবতার স্বঘোষিত দায়িত্বপ্রাপ্তদের পিলে চমকানোর কী আছে? নির্বিচারে মানুষ হত্যার জন্য আইএস বা আলকায়দা ‘জঙ্গি’ ও ‘সন্ত্রাসী’ হলে বিমান বা ড্রোন হামলায় নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজটি ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গি’ তৎপরতা হিসেবে বিবেচিত হবে না কেন? লক্ষণীয় উভয় ক্ষেত্রে হামলার শিকার কেবলই মুসলমান। প্রচারণার জোরে ক্রুসেডরাই এখন ইসলামের রক্ষক ও সেবক!
আজকের জেনেভা-চুক্তি ও যুদ্ধ আইন প্রণীত হওয়ারও প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাসূল (সা.) এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন, কোনো অসামরিক ব্যক্তি হোক সে যুবক, নারী-শিশু বা বৃদ্ধ কারো ওপর আক্রমণ করা যাবে না। ফসল, বৃক্ষ-তরু বাসগৃহ, নিরস্ত্র ও আত্মসমর্পিত প্রতিপক্ষ কোনো অবস্থাতেই আক্রমণের লক্ষ্য হবে না। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের ময়দানেও যে মানবতার দাবি উপেক্ষণীয় নয়, এটি শিখিয়েছে ইসলাম দেড় হাজার বছর আগে, যখন ‘নারী মানুষ কিনা’ এই বিতর্ক চলছিল ইউরোপজুড়ে। কালো আফ্রিকান আর রেড ইন্ডিয়ানরা তো মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেল এই সেদিন মাত্র। আর এখন ‘শিম্পাজির মানবাধিকার’ কথা বলে চমক সৃষ্টি করা হচ্ছে, অথচ লাদেনের মানবাধিকারের খবর নেই। যুদ্ধের ময়দানেও প্রতিপক্ষ যে মানবাধিকার থেকে বাদ যায় না। ইসলামের ইতিহাস থেকেই তার দু-চারটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক।
ক্রুসেডের দামামা বাজিয়ে সমগ্র ইউরোপ থেকে সংগৃহীত বিশাল বাহিনী নিয়ে বসফরাস প্রণালি অতিক্রম করে কিংরিচার্ড জেরুজালেম দখলে অগ্রসর। প্রতিপক্ষ মুসলিম বাহিনী গাজী সালাহ্উদ্দিনের নেতৃত্বে আগ্রাসন প্রতিরোধে অগ্রসর। জয়-পরাজয়হীন যুদ্ধ চলল কয়েক দিন। একপর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন সেনাপতি রিচার্ড। বিষয়টি গোপন থাকে না গাজী সালাহ্উদ্দিনের কাছে। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকও ছিলেন সেনাপতি সালাহ্উদ্দিন। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে হেকিমের ছদ্মবেশে শত্রু শিবিরে উপস্থিত হলেন সালাহ্উদ্দিন। দিন কয়েকের চিকিৎসায় সেরে উঠলেন রিচার্ড। হেকিমের পরিচয় জানার পর ক্রুসেড সেখানেই শেষ।
মাসাধিককাল থেকে জেরুজালেম অবরোধ করে আছে মুসলিম বাহিনী। নগর অধিপতির এক কথা, স্বয়ং খলিফা ওমর ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না তিনি। মদিনায় খলিফা ওমরের কাছে খবর পাঠানো হলো। অযথা রক্তপাত এড়াতে একটি মাত্র ভৃত্য আর একটি উট নিয়ে খলিফা ওমর (রা.) হাজার মাইল মরুপথ পাড়ি দিয়ে জেরুজালেমে উপস্থিত হলেন। বিনা রক্তপাতে জেরুজালেম জয় হলো।
দুনিয়ার ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের মতো রক্তপাতহীন বিজয় দ্বিতীয়টি আছে কী? ১৩টি বছর ধরে একটানা অত্যাচার-নির্যাতন অবশেষে হত্যার সিদ্ধান্ত! বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ। মদিনায় গিয়েও তিন তিনবার হানা দিল যে কুরাইশরা, মৃত হামযার কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিল যারা, তাদের কারোরই কৃত অপরাধের শাস্তি দেয়া হলো না। মক্কা বিজয়ের পর দখল রক্ষার জন্য কোন সৈন্য বাহিনী মোতায়েন ছাড়াই মদিনায় ফিরে এলেন রাসূল (সা.)। অথচ সেই বিজয় আজ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়নি একদিনের জন্যও।
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘বদর যুদ্ধ’। আক্রমণকারী সুসজ্জিত কুরাইশ বাহিনী। এক হাজারের বিপক্ষে মাত্র ৩১৩ জন। এই অসম যুদ্ধে কুরাইশদের ঘটল শোচনীয় পরাজয়। নিহত ৭০, আর বন্দি হলো ৭০ জন। বন্দিদের বন্দিখানায় না রেখে আত্মীয় কুটুমের মতো আনসার মুহাজিদদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হলো। বন্দিদের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী ন্যূনতম মুক্তিপণের ব্যবস্থা করা হলো। বন্দিদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল তাদের প্রত্যেকের মুক্তিপণ হিসেবে মদিনার ১০টি ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। বন্দিদের দেয়া হলো শিক্ষকের মর্যাদা। এমন নজির ইতিহাসে আর কোথায় পাওয়া যাবে? তাবুক অভিযান রাসূল (সা.)-এর জীবনে শেষ যুদ্ধাভিযান। অভিযানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। বসরা তখন রোম সা¤্রাজ্যের অংশ। রাসূল (সা.) বসরার গভর্নর শেহরাবিল ইবনে গাশ্্সামীর উদ্দেশ্যে লেখা একটি পত্রসহ হযরত হারেস ইবনে ওমায়রকে প্রেরণ করেন। শেহরাবিল পত্র বাহককে নির্যাতনপূর্বক হত্যা করেন। এর জবাবে রাসূল (সা.) যায়েদ ইবনে হারেশের নেতৃত্বে মাত্র ৩ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। মুতা নামক স্থানে উভয় পক্ষে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রায় দুই লক্ষ রোমান সৈন্যের বিরুদ্ধে ৩ হাজার সৈন্যের এক অসম যুদ্ধেও শেষ পর্যন্ত মুসলমানদেরই জয় হলো। যুদ্ধের ফলাফল রোমানদের ভাবিয়ে তুলল। তারা এবার মদিনা আক্রমণের লক্ষ্যে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিলেন। নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীসহ তিনি রোমানদের মোকাবেলায় অগ্রসর হলেন। তাবুক নামক স্থানে উভয় বাহিনী কাছাকাছি হলো। এবার মুসলিম বাহিনী তিন হাজার নয় অনেক বেশি এবং স্বয়ং তাদের নেতা মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ খবর রোমানদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল। যুদ্ধ না করেই রাতের আঁধারে তারা পিছু হটে গেল। মুসলিম বাহিনী ইচ্ছে করলেই তাদের কিছু ধাওয়া করে এজিয়ান সাগরের ডুবাতে পারতো কিন্তু তা করা হলো না। কারণ অযথা রক্তপাত ও প্রাণহানী ইসলামের কাম্য নয়। দূত হত্যার প্রতিশোধ নিতে একজন মানুষকেও হত্যা করা হলো না। বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের মতোই আর একটা বিজয় হলো তাবুক প্রান্তরে। রাসূল (সা.)-এর জীবনের শেষ যুদ্ধেও তিনি এভাবেই জয় ছিনিয়ে নিলেন।
এত গেল নবী আর সাহাবাদের সময়ের কথা। শত্রুর প্রতি উদারতার কিংবদন্তিমূলক ঘটনা এদেশেও আছে। মুঘল সেনাপতি মানসিংহ আর ঈশাখাঁর ঘটনা কে না জানে? এ যদি হয় মুসলমানদের যুদ্ধনীতি তা হলে এর সাথে কথিত ইসলামী বাহিনী ‘আইএস’ বা ‘আলকায়েদা’র মিল কোথায়? বরং মিল খুঁজে পাওয়া যাবে তো তাদের সাথে যারা শুধু ক্ষমতা প্রদর্শনে ঠা-া মাথায় আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লক্ষ মানুষের জীবনহানী ঘটায়। তালেবান-আলকায়েদা নিধনের নামে বধির বোবা ড্রোন হামলায় নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষের জীবনহানী ঘটিয়ে বিজয়ের আনন্দে হয় উদ্বেলিত।
মানবতার বিরুদ্ধে রক্তপাতের জন্য ইসলাম বা মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আগে দুটি বিশ্বযুদ্ধে আট কোটি মানুষ হত্যা আর শত কোটি মানুষের পঙ্গুত্বের জন্য দায়ীদের কাঠগড়ায় আনা হবে না কেন? ভিয়েতনাম, ইন্দোচীন, লাওস, কম্বোডিয়া, এঙ্গোলা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়াসহ সমগ্র আফ্রিকা আজও কসাইখানায় পরিণত করে রেখেছে কারা? কঙ্গো, জাম্বেসী, নাইজার, আর নীলের পানি বারবার লাল হলো কাদের পাপে? আফ্রিকার কালো নিগ্রো আর রেড ইন্ডিয়ানদের পশুর মতো ব্যবহার করেছিল কারা? বিশ্বজুড়ে স্বাধীন জনপদগুলোকে অস্ত্রের জোরে উপনিবেশে পরিণত করার জন্য দায়ী কারা? আজও পৃথিবীর দেশে দেশে মানবতার আর্তনাদের মূলে কারা? ৬/৭ লক্ষ মানুষ খুন আর লক্ষ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংসের পর এখন বলা হচ্ছে ইরাক যুদ্ধ ভুল ছিল, আগামীকাল হয়তো বলা হবে আফগান যুদ্ধ বা ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ভুল বা অপরাধ ছিল। হয়তো শত বছর পর কোনো গোপন তথ্য ফাঁসে জানা যাবে ৯/১১-এর ঘটনার জন্য দায়ী লাদেন নয়, বুশ জীবিত ধরার পরও লাদেনকে কাঠগড়ায় না তোলার জন্য হয়তো একদিন দায়ী হবেন ওবামাও। এসব অপকর্ম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ না হলে নীতিশাস্ত্র নতুন করে লিখা হবে না কেন? বুশ-ব্লেয়ার বাগদাদে যা ঘটালেন সাদ্দাম যদি লন্ডন-ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে তেমনটি করতেন তাহলে ইঙ্গো-মার্কিনীরা ইরাকীদের কী আলিঙ্গন করে চুমু খেত? হালাকু খাঁ বাগদাদ ধ্বংস করেছিলেন, পুড়িয়ে দিয়েছিলেন সে যুগের বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার আর ইঙ্গ-আমেরিকানরা লুট করেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য বাগদাদের যাদুঘর। মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধের এই ধারাবাহিকতায় ‘শিম্পাজির মানবাধিকার’ চিন্তা মানবতার প্রতি প্রহসনের নামান্তর নয় কেন? আণবিক বোমার বিস্তার রোধে নিজেদের মজুদ সমৃদ্ধ করার নীতি বহাল রেখে অন্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবার কী নৈতিক যুক্তি থাকতে পারে ‘শান্তির পায়রা’দের? সুতরাং হিরোশিমা-নাগাসাকির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ‘ইসলামী বোমা’ নামে চালিয়ে দেয়া হবে না কখনো এমন নিশ্চয়তা দেবে কে, যখন লাদেন আর সাদ্দামের কাছে আণবিক বোমা থাকার মতো নিলর্জ্জ অসত্যও বাজারজাত করা যেতে পারে?
এখন প্রশ্ন হলো চলমান ক্রুসেডে বুশ ঘোষিত অজুহাতগুলো মিথ্যে হলে (ব্লেয়ারের স্বীকারোক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য) সত্যকে জয়যুক্ত করার উপায় কী? বোধকরি এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন দুর্ভাগ্যের কারণ চিহ্নিতকরণ। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান নাজুক অবস্থা সৃষ্টি এবং বুশদের অব্যাহত আগ্রাসন ও খবরদারির মূলে রয়েছে ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন তথা সীমাহীন ক্ষমতার লোভ যা যুগপৎ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় অনৈক্যেরও মূল কারণ। আমরা প্রায়ই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলি কিন্তু করি তার ঠিক উল্টোটাই। অবশ্য এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, মানুষ বিশেষত ক্ষমতাসীনরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসহারা শাসক মাত্রই এক ধরনের অভিভাবকহারা ইয়াতিমের মতো। সুতরাং মোড়ল আর সুবিধাভোগীদের দয়া ও আশীর্বাদ ছাড়া তাদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। প্রতিবেশী নেপাল আর বাংলাদেশের রাজনীতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অবস্থাও প্রায় একই রকম।
প্রতিপক্ষ ‘ক্লাইভের উত্তরসূরিরা’ এই সুযোগটা কাজে লাগাবে, এটাই যদি হয় তাদের কাজ তা হলে ‘সিরাজদের’ দুর্ভাগ্যের জন্য অভিযুক্ত করব কাকে? সুতরাং ইজ্জত ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে হলে চলমান ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জেতার কোনো বিকল্প নেই। আর জেতার জন্য আণবিক বোমারও প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু একটি প্রশ্নে আপসহীন জাতীয় ঐক্য। আর তা হলো গণতন্ত্র, নির্ভেজাল গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র ক্ষমতায়ন শুধু জীবনের চেয়েও দামি বিবেচিত হবে। যুক্তরাজ্য খ-িত হবে কি এক থাকবে এমন কঠিন ও জটিল সিদ্ধান্ত যদি ব্যালটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নির্ধারিত হতে পারে (ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল ছাড়া) তা হলে মুসলমানদের ‘পান থেকে চুন খসলেই’ বুলেটের দরকার হবে কেন? অনেকের মুখেই প্রগতি ও আধুনিকতার কথা শুনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো নিরেট গণতন্ত্রী না হয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল হওয়া কীভাবে সম্ভব? ক্রুসেডাররা এ বিষয়টি বোঝেন বলেই মুরসি জেলে আর সিসি তাদের হয়ে ছড়ি ঘুরান। বাংলাদেশ-তুরস্ক এ প্রশ্নে এক ও অভিন্ন। ১/১১-এর সৃষ্টিও এ কারণেই। মনে রাখতে হবে, এ বেলা সাপ ও ওঝা আসলেই এক। ওঝার লক্ষ্য পূরণ পর্যন্ত আইএস সাপের ভূমিকায় থাকবেই। সুতরাং আইএসএর মতো ক্রীড়নকদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই বোধকরি এ যুগের সর্বোত্তম জিহাদ বা প্রকারান্তে ৪র্থ ক্রুসেডের মোকাবিলারই শামিল।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন