চলতি বছর আউশ, বোরো ও আমনে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। সরকারি মজুদ ও সর্বকালের সর্বোচ্চ, তারপরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকারের হিসেব অনুযায়ী দেশের গুদামগুলোতে ধারণ ক্ষমতা ২০ লাখ ২১ হাজার ৬০২ মেট্রিকটন। বর্তমানে মজুত রয়েছে ১৯ লাখ ৯০ হাজার ৩০৯ মেট্রিকটন। অথচ ভরা আমন মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। চালের মূল্য নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি সংস্থার হিসাবে বাজারে চালের যে দাম হওয়া উচিত, তার চেয়ে কেজিতে ১১ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
দেশে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রক মূলত চালকলমালিকেরা। তাদের মধ্যে আবার হাতে গোনা কয়েকজন মূল ভূমিকা পালন করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় মিলারদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদ।
স্বীকার করেছেন সরকারের কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, সরকারি মজুদও সর্বকালের সর্বোচ্চ, তারপরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায়, চালের মূল্য নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হলে দ্রুত চালের উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশে আমন মৌসুমে নবান্নের সময়ও চালের দাম বাড়ছে। এ বছর আউশ, বোরো ও আমনে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। চালের চাহিদার অনুপাতে দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে।
বাজারে চালের চড়া দামের মধ্যে উচ্চহারে মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। কৃষি বিপণন অধিফতরের হিসাবে বাজারে চালের যৌক্তিক যে মূল্য হওয়া উচিত, তার চেয়ে কেজিতে ১ থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হচ্ছে। বাজারে এখন এক কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ দর। এ ছাড়া মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা এবং সরু চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শুধু এখন নয়, করোনার মধ্যে সারা বছরই চাল চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। সরকার গত বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচ ও মুনাফা যুক্ত করার পর সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দাম নির্ধারণ করেছিল ৩৬ টাকা। আমনে তা কেজিপ্রতি ৩৭ টাকা ধরা হয়। অবশ্য গত বোরো মৌসুম শেষে বছরজুড়েই মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ধানের উৎপাদন বাড়াতে অতি উচ্চফলনশীল ইনব্রিড ও সুপার হাইব্রিড জাতের আবাদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জানানো হয়, কৃষি জমি ক্রমশ কমছে। চালের উৎপাদন বাড়াতে গেলে নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ উৎপাদনশীল জাতগুলোকে দ্রুত মাঠে নিয়ে যেতে হবে এবং সুপার হাইব্রিডের চাষ বৃদ্ধি করতে হবে। পাহাড়, হাওর, উপকূলসহ প্রতিকূল এলাকায় ধানের চাষ সম্প্রসারণ করতে হবে। আগামী বোরো, আউশ, আমন মৌসুমে ধানের উৎপাদন বাড়াতে সময়াবদ্ধ সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। নতুন উদ্ভাবিত অতি উচ্চ ফলনশীল ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯২ বোরো জাতের ধানের উৎপাদন প্রতি শতাংশে প্রায় ১ মণ। এটিকে দ্রুত মাঠে নিতে এবার বোরোতে ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯২ ধান যেসব কৃষকেরা চাষ করবে, তাদের লিস্ট করে উৎপাদিত ধানের সবটুকু বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে বীজ হিসেবে কিনে নেয়া হবে। যাতে বীজ সঙ্কট না হয়। চাষিদের নিকট জনপ্রিয় করতে বিনামূল্যে বীজ দেয়া হবে, সারের দাম আরো কমিয়ে দেয়া প্রয়োজন।
সভায় কৃষিমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি দেশে চালের দাম কিছুটা অস্থিতিশীল ও ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারেও খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে গমের দাম টনপ্রতি ২৩০-২৮০ ডলারের মধ্যে ছিল, তা বেড়ে এখন ৪৫০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৪৮ লাখ টন, আর এ অর্থবছরে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ১৬ লাখ টন। দাম বাড়ার কারণে গম আমদানি কম হচ্ছে। ফলে আটা, ময়দার দাম চালের চেয়ে বেশি, অথচ সবসময়ই আটার দাম চালের চেয়ে কম থাকে। এছাড়া, দেশে ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। প্রতিবছর ২২-২৪ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। প্রাণি-মৎস্যের খাদ্য হিসেবেও চালের কিছু ব্যবহার হচ্ছে। মানুষের আয় এবং জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। এসব মিলে চালের চাহিদা ও কনজামশন দিন দিন বাড়ছে। ফলে, চালের দাম কিছুটা বেশি, তবে এই মুহুর্তে দেশে খাদ্যের কোনো সঙ্কট নেই।
কৃষি বিপণন অধিদফতর পাইকারি বাজারের দামের সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, অন্যান্য খরচ, মুনাফা যোগ করে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে। গত রোববারের যৌক্তিক মূল্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারে এক কেজি জনপ্রিয় মিনিকেট চালের দর হওয়া উচিত ৫৩ থেকে ৫৬ টাকা। অথচ তাদের হিসাবেই এ চাল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মানে হলো, বাড়তি মুনাফা করা হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭ থেকে ৯ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, চালের যৌক্তিক মূল্য তারা খাদ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মিলগেট মূল্য ধরে নির্ধারণ করেছে। অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মূল্য বাজারে কার্যকর হয়নি। এসব যৌক্তিক মূল্য ঘোষণাই করা হয়, কার্যকর করতে উদ্যোগ নেয়া হয় না।
কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী, ঘোষিত যৌক্তিক মূল্য বাস্তবায়িত না হলে সরকারি সংস্থাগুলো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। যদিও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে বাজার থেকে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে যৌক্তিক মূল্য তুলে ধরি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের বাজার অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এক যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, দেশে প্রতি কেজি ধান বিক্রি করে কৃষকের লাভ হয় ৬০ পয়সা থেকে ১ টাকা। চালকলমালিকেরা প্রতি কেজি চালে লাভ করেন আড়াই থেকে তিন টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরাও প্রায় একই পরিমাণে লাভ করেন। এর বাইরে পাইকারি ব্যবসায়ী, এজেন্ট ও ফড়িয়ারা কেজিপ্রতি দেড় থেকে আড়াই টাকা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন