বোরো ধানের ভরা মৌসুম চলছে। এ সময় বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে চালের বাজার খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই এ পণ্যটির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে কেজি প্রতি ৭ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। এমনিতেই তেল, চিনি, ডালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম লাগামহীন ভাবে বাড়তে থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
ভরা মৌসুমে এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের কারসাজির কথা বলছেন। আবার মিলারা সময়মত ধান কাটা ও মাড়াই না হওয়ায় ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে এমন দাবি করছেন। আবার কেউ কেউ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ছে এমনটা বলছেন।
কোনো কোনো চাল ব্যবসায়ী বলছেন, দেশে প্রচুর চাল মজুত আছে। বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে চালের দামও বাড়তে পাওে, এমন আশঙ্কায় সাধারণ ক্রেতা বেশি করে চাল কিনছেন। সে কারণে চালের চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে। তবে চলতি মৌসুমে উৎপাদন বেশি হয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না ঘটলে চালের কোনো সঙ্কট হওয়ার আশঙ্কা নেই।
তবে চালের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে কেন তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজার দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। মন্ত্রিসভা বৈঠকে গতকাল প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দিয়েছেন। তেলের মত চালের বাজারেও কেউ কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে কি-না তা বাজার তদারকি করে গোয়েন্দাদের বের করতে বলেছেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তারপরও সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে সব ধরনের চালের। পরিস্থিতি এমন হয়েছে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে বাজারে পণ্যটি কিনতে ভোক্তা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি আটাশ জাতের মোটা চাল ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে ৫০ টাকা কেজির মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। নাজিরশাল চিকন জাতের চাল কয়েক দিন আগে ৭০ থেকে ৭২ টাকা বিক্রি হলেও এখন তা ৭৮ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর শুধু মিলারদের কারসাজিতে বাজারে চালের দামে অস্থিরতা দেখা দিত। এবার মিলারদের সঙ্গে বড় কিছু কোম্পানি সুযোগ নিচ্ছে। তারা মাঠে ধান পাকার আগেই কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে রেখেছেন। সেই ধান কাটার পর তাদের গুদামে মজুদ করছেন। পরিস্থিতি বুঝে তারা চাল বাজারে ছাড়ছেন। এতে বাজারে ধান সংগ্রহে কিছুটা সঙ্কট দেখা দেওয়ায় মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েছে। যা সরাসরি ভোক্তার ওপর প্রভাব ফেলেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হাওড়ে বন্যায় ৮০ হাজার টন চাল নষ্ট হওয়ার পরও এবার বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭ লাখ টনের ওপরে চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) বৈশ্বিক দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এ বছর দেড় লাখ টন চাল বেশি উৎপাদিত হবে। এমন চিত্রের পরও বাজারে চালের দাম বাড়ছে।
রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেইট কাঁচাবাজারের মোল্লা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মো. আফজাল হোসেন গতকাল বলেন, প্রতিকেজি মিনিকেট ৬৬-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা দুই সপ্তাহ আগে ৬০-৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নাজিরশাল চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৭ টাকা। যা আগে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতিকেজি স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা, যা আগে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। যে কারণে বেশি দরে এনে বেশি দরে তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের চাল বিক্রেতা মো. আজিজুর রহমান বলেন, মিল থেকে প্রতি সপ্তাহে বাড়তি দরে চালের রেট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বোরো মৌসুমে এমন দাম বাড়ার চিত্র এর আগে কখনো দেখিনি। এবার প্রথম দেখলাম। পাইকারি পর্যায়ে এখন প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৩৩০০ টাকা। যা সাত দিন আগে ৩২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ১৪ দিন আগে ছিল ২৯০০ টাকা। বিআর ২৮ চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৪০০ টাকা। যা আগে ছিল ২২০০ টাকা। মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৩০০ টাকা। যা আগে ২০৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের বাজার তদারকি দুর্বল হওয়ায় বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। সরকার যদি কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো তাহলে এমনটা হতো না। কেন এমন পরিস্থিতি হয়েছে তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। বিশ্ববাজারের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের বাজার অস্থির করতে না পারেন সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে বাজারে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন