বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধভাবে মজুত ঠেকাতে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আভিযানিক টিম। দোকানে লাইসেন্স ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না, চালের মজুতের হিসেবেও গরমিল,এবং অভিযান শুরুর পর অনেক ব্যবসায়ী দোকান ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন। মিল মালিকদের সঙ্গে জেলা-উপজেলা এবং বিভাগীয় খাদ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজস ঘুরেফিরে বারবার আলোচনায় আসছে সিন্ডিকেটদের দৌরাত্ম্যের কথা। কিন্তু জড়িত থাকা খাদ্য কর্মকর্তাদের কিছুই হচ্ছে না।
সমস্যা পুরনো, তবু মিলছে না সমাধান। বাজারে গিয়ে মাসের চালের খরচ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। মোটা চালের দামও চলে গেছে গরিবের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এদিকে মিলার ও বড় ব্যবসায়ীরা সীমিত আকারে ধান কেনার প্রেক্ষিতে বিরামপুরের আড়তদাররা গতকাল কৃষকদের নিকট থেকে ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। একটিমাত্র আড়ত এক দিনের ব্যবধানে মন প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কম দামে সীমিত আকারে ধান কিনছে। এতে ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকরা ধান বিক্রি করতে না পেরে ধান নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধভাবে মজুত ঠেকাতে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আভিযানিক টিম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আটটি টিম মাঠে নেমেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার দুপুরে কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন চালের আড়তে অভিযান চালায়। অভিযানের খবর পেয়ে চাল ব্যবসায়ীদের অনেকে দোকানপাট ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মর্জিনা আক্তার গতকাল উপস্থিত সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, কারওরান বাজারে বিভিন্ন চালের আড়তে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সে গরমিল পাওয়া গেছে। গরমিল রয়েছে চালের মজুতেও।
বোরো মৌসুমে ভালো ফলনের পরও চালের বাজারে দাম নিয়ে অস্তিুর কাটছে না। উল্টো পথে হাঁটছে চালের বাজার। বছরের এমন সময় যেখানে চালের দামে একটু স্বস্তি মেলার কথা, সেখানে দাম কেবল বাড়ছেই। এ নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করছেন মিল মালিক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। এসময় চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স আছে কি না, অনুমোদনের চেয়ে বেশি চাল মজুত আছে কি না, ফুড গ্রেইন লাইসেন্স যাচাই, খাদ্যশস্যের কেনা-বেচার রশিদ, মিল গেটে কী মূল্যে চাল বিক্রি হচ্ছে, খুচরা-পাইকারি বিক্রেতার ক্যাশমেমো, খুচরা মূল্যতালিকা প্রদর্শন- এসব বিষয় যাচাই করতে দেখা যায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আভিযানিক টিমকে। অভিযানে আড়ত মালিকেরা কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না। মর্জিনা আক্তার বলেন, যে দোকানে যাচ্ছি, কোনোটারই লাইসেন্স ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। চালের মজুতের হিসেবেও গরমিল রয়েছে। আমরা অভিযান শুরুর পর অনেক ব্যবসায়ী দোকান ফেলে চলে গেছে। এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে পরবর্তীসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে একইদিন দুপুরে ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে শাহ স্মৃতি মার্কেটের পাইকারি চালের আড়তে অভিযান শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্রের নেতৃত্বে শুরুতেই মেসার্স তাইয়্যেবা রাইস এজেন্সি নামের একটি আড়তে অভিযান চালানো হয়। সেখানে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রির রশিদ খুঁজে পান দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট। এবিষয়ে দোকান মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে দোকানের বৈধ লাইসেন্স বা অনুমোদন রয়েছে কি-না, তা-ও দেখা হচ্ছে। এসময় তাইয়্যেবা রাইস এজেন্সিতে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে যেসব চালের দাম বেশি সেগুলোর দাম লেখা হয়নি। সে কারণে এই দোকানে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে তাইয়্যেবা রাইস এজেন্সির কর্মচারী শফিকুল ইসলাম জানান, রাতে আমাদের চাল এসেছে। তাই আমরা মূল্য তালিকা নতুন করে হালনাগাদ করার সুযোগই পাইনি। এমনকি আজ এখনও কোনো চাল পাইকারি বিক্রি করিনি। এজন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করাটা খুবই অন্যায্য।
অপরদিকে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিরামপুর চাল আড়তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় সকাল থেকেই সব ধরনের চাল প্রতি কেজিতে ৪-৫ টাকা কম দরে আড়তদারেরা বিক্রি করতে শুরু করেছে। কাটলা এলাকার ধান বিক্রেতা সাদেক আলী জানান, এক দিন আগে ১ হাজার ৪শ টাকা মন দরে মিনিকেট ধান বিক্রি করেছেন। বুধবার সেই ধানের দাম কমে ১ হাজার ২৫০ টাকা হয়েছে। এভাবে প্রকার ভেদে প্রতি মণ ধান ১০০ থেকে ১৫০ টাকা হারে কমে গেছে। এ কারণে তিনি ধান নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বিরামপুর ধানহাটির ধান আড়তদার মহিবুল ইসলাম জানান, ধানের জেলা দিনাজপুরের খাদ্য উদ্বৃত্ত বিরামপুর শহরে ধান কেনার জন্য ২১টি আড়ত রয়েছে। তারা উপজেলায় উৎপাদিত ধান কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকার মিলার ও বড় ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে থাকে। কিন্তু ধান চালের অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের একাধিক টিম মাঠে নামার প্রেক্ষিতে মিলার ও বড় ব্যবসায়ীরা ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে বিরামপুর শহরের একমাত্র সুমি ট্রেডার্স সীমিত আকারে ধান কেনা ব্যতিরেকে অপর ২০টি আড়ত বুধবার থেকে ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে একদিনের ব্যবধানে প্রতি মণ ধান প্রকার ভেদে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কম দরে বেচা-কেনা করা হয়েছে।
অপরদিকে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিমল কুমার সরকার বিরামপুর চাল আড়তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৬টি আড়তের ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। নতুন বাজারের চাল আড়তদার কার্তিক কুণ্ডু জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পর বুধবার সকাল থেকেই বাজারে সব ধরনের চাল প্রতি কেজি ৪ থেকে ৫ টাকা কম দরে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরে আগাম পানি এসে যাওয়া ও অতিবৃষ্টির কারণে ৮০ হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছে। তার পরও এবার বোরোতে ২ কোটি ৭ লাখ টনের বেশি চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ে দাম বাড়ার কথা নয়। দেশের বাজারে প্রায় ৬০ শতাংশ চালের জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে। এরই মধ্যে এ মৌসুমের প্রায় অর্ধেকের বেশি ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। বাজারে ধানের সরবরাহও বেড়েছে। সরবরাহ বাড়লেও খুচরা ও পাইকারি চালের বাজারে তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। যদিও কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমতির দিকে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার তদারকিতে কাজ শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আটটি টিম। পাশাপাশি কেউ অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবে এসব টিম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর চালের দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত আটটি টিম গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।
গত মাসে বোরো মৌসুমের ধান কাটা পুরোপুরি শুরু না হওয়ার কারণে বাজারে ধানের সরবরাহ কম ছিল। কিন্তু চলতি মাস থেকেই পুরোদমে বাজারে ধানের সরবরাহ বেড়েছে। ধানের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মিলাররা ধান সংগ্রহ বাড়িয়েছেন। দেশের বাজারগুলোয় ধানের দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমতির দিকে। গত বছর ভালো মানের প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার টাকার বেশি পেলেও চলতি বছর তা ১ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিক সাধারণ ধানের দাম প্রতি মণ ৮৫০-৯০০ টাকা হলেও চলতি মৌসুমে বিভিন্ন জেলায় ধানের দাম ৮০০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ফলে কম দামে মিলার ও ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারছেন। কিন্তু সেই ধান যখন চাল হয়ে বাজারে প্রবেশ করছে তখন আর তার দামের ওপর সরবরাহ বেশি বা কম সংগ্রহ মূল্যের বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান-চালের অবৈধ মজুদ ঠেকাতে গতকাল থেকেই মাঠে নামিয়েছে আটটি টিম।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কেউ অবৈধভাবে মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে এ টিমের সদস্যরা। একই সঙ্গে অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেবেন তারা। চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজার পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে গত সোমবার নির্দেশ দেয় মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ দেয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বেশি—বৈঠকে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং বাজার জরিপ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ভরা মৌসুমে কেন চালের দাম এত বেশি থাকবে সে প্রশ্ন রেখে সচিব বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনে সব নিয়ম স্পষ্ট করে বলাই আছে। ফলে সেটির কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে কিনা সেটি দ্রুত দেখতে খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্য সচিব, বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে বলা হয়েছে। এর একদিন পরই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হলো ধান ও চালের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে মাঠে নামছে আটটি টিম। গতকাল খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে তার অফিস কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গতকালের সভায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন