শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চালের দাম ঠেকাতে মাঠে প্রশাসন

অভিযানে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৮ টিম অভিযানের খবর পেয়ে পালিয়েছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা মুনাফার আশায় মজুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে : খাদ্যমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

চালের বাজার অস্থির। রাজধানীসহ সারা দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোতে চাল কিনতে গেলেই বিপাকে পড়তে হচ্ছে ক্রেতাদের। অনেকেই আবার প্রয়োজনের চেয়ে পরিমাণে কম চাল কিনে বাড়ি ফিরছেন। পাইকারী ব্যবসায়ীরা জনিয়েছেন, আরতদার ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে চাল চাইলে তারা পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। কোন কোন সময় টাকা অগ্রিম পাঠালেও চাল দিতে পারছেন না। আবার অনেক ব্যবসায়ী বলছেন আরও দাম বেশি পাবার আশায় আরতদাররা চাল মজুদ করছেন। এসব নানা কারণে দিন দিনই বাড়ছে চালের দাম। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দাম ৩ দশমিক ৯২ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটো রাইস মিল মালিকরা চাল মজুত করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের সরবরাহ নেই। আগের অর্ডারের চালও ঠিকঠাক মতো পাচ্ছেন না তারা।

সারা দেশে ধান ও চালের অবৈধ মজুদ খুঁজে বের করতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মাঠে নামবে খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন তদারক সংস্থা। গতকাল মঙ্গলবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামাল হোসেন। তিনি বলেন, অবৈধ মজুদ প্রতিরোধে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এনএসআই, র‌্যাব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকেও চিঠি দেয়া হবে। গতকাল ঢাকার বাবু বাজার এলাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল অভিযানে যাবে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, পুলিশি সহযোগিতা পাওয়া সাপেক্ষে বিকালে দলটি মাঠে নামবে। পাশাপাশি ঢাকা কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোতে যাবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি টিম। খাদ্য অধিদফতরের পাঁচটি টিমও পাশাপাশি কাজ করবে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও অভিযান চলবে। বিপণন পর্যায়ে কোন দোকানে কতটুকু মজুদ রাখা যাবে সেটা আইনে বলা আছে। যদি অবৈধ মজুদ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

২০১১ সালে জারি করা বিধিতে বলা হয়, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি খাদ্য সামগ্রী তার অধিকারে রাখতে পারবে না। অনুমোদিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ী সর্বোচ্চ তিনশ’ টন ধান অথবা চাল ত্রিশ দিন পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন। খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৫ টন ধান অথবা চাল ১৫ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। চালকল মালিকরা পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দ্বিগুণ চাল সর্বোচ্চ ১৫ দিন মজুদ রাখা যাবে। হাস্কিং মিল মালিকরা সর্বোচ্চ ১০০ টন ১৫ দিন মজুদ রাখতে পারবেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযান শুরুর খবর পেয়ে পালিয়ে যান রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ীরা। জরিমানা এড়াতে তারা এমন করেছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি মার্কেটের পাইকারি চালবাজার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম মন্টু।

গতকাল কৃষি মার্কেটে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একটি টিম। এ সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সদস্যদের বারবার অনুরোধের পরও দোকানে আসেননি দোকানিরা। তবে তার কিছুক্ষণ আগে মূল্য তালিকায় অসঙ্গতি থাকায় ওই বাজারের এসএম রাইস এজেন্সি ও আনোয়ার ট্রেডার্স নামের দুটি দোকানকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকান ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তার বলেন, আমরা আজ এসেছি চালের দাম কেন বেড়েছে, সেটার খোঁজ নিতে। আমাদের আসার খবরে অনেক চাল ব্যবসায়ী দোকান থেকে পালিয়ে যান। পরে তাদের অনেক অনুরোধ করা হলেও তারা দোকানে ফিরে আসেননি।

তিনি আরও বলেন, চাল যে দামে কেনেন, সেখান থেকে দোকান পর্যন্ত আসতে প্রতি কেজিতে তাদের আরও দুই টাকা খরচ পড়ে। পরে এক টাকা (প্রতি কেজি) লাভে সেই চাল বিক্রি করেন তারা। যদিও মূল্য তালিকায় প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা বেশি দেখা গেছে।

গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ধান-চালের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। যেখান থেকে দেশের কোথাও অবৈধ মজুদ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগে তেলের (ভোজ্যতেল) বিপরীতে যেভাবে ড্রাইভ দেয়া হল, ওই রকম ড্রাইভ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি কেউ এভাবে (নিয়ম-নীতি ভেঙে) আনঅথরাইজড চালের ব্যবসা করে বা মজুদ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আজকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

চলতি বোরো মওসুমে ধানের কাঙ্খিত ফলন হলেও বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ধান চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলছে। বড় বড় মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভালো মুনাফার আশায় ধানের মজুদ শুরু করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ব্যবসায়ীদের মজুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও উৎপাদনে যাচ্ছে না। প্রতিবছর বোরো মৌসুমের ধান বাজারে আসার পর চালের দাম কমতে শুরু করলেও এবার ঘটছে উল্টোটা। নতুন ধান বাজারে আসার পর থেকে চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে বলে খুচরা বিক্রেতারা দাবি করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে।
আর মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে নতুন ধান আসলেও দাম চড়া। গত বছরের তুলনায় প্রতিমণ ধানে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি গুণতে হচ্ছে। দুই পক্ষের বক্তব্য সরাসরি নাকচ না করলেও খাদ্যমন্ত্রীর কথায় উঠে আসে বাজারে অশুভ প্রতিযোগিতার কথা। তিনি মজুদদারির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বিদেশে থেকে চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হবে বলেও জানান খাদ্যমন্ত্রী।

মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এক আড়তদার বলেন, চালের জন্য ফোন দিলেই মিল মালিকরা বলেন নেই। দাম বাড়িয়ে দিতে পারলে কিছুটা দিতে রাজি হয়। যদিও পরবর্তীসময়ে বাড়তি দামে ঠিকঠাক মতোই চাল দেয় তারা। চালের সঙ্কটের কথা চিন্তা করে সবাই মজুত করেছে। দাম বাড়িয়ে বিক্রি করবে। ভরা মৌসুমে এত সঙ্কট কখনো হয়নি।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম লায়েক আলী বলেন, হাওরে ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে বোরোর আগাম চালের সরবরাহে সমস্যা হয়েছে। অন্যান্য বেশিরভাগ এলাকায়ও বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে সমস্যায় পড়েছেন। অনেকে এখনো ধান মিলে দেননি। আবার অনেক মিলে অপুষ্ট ধানের কারণে চালের পরিমাণ কমেছে। তারপরও মিলাররা সেভাবে চালের দাম বাড়াননি। মিলগেটে চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, ধান ও চালের অবৈধ মজুদ রোধে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। অবৈধ মজুদের বিষয়ে সেখানে তথ্য জানাতে +৮৮০২২২৩৩৮০২১১৩, ০১৭৯০৪৯৯৯৪২ এবং ০১৭১৩০০৩৫০৬ নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ করা হয়েছে।###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন