শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

৭ নভেম্বর : জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন

প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কালাম ফয়েজী
এজাতি এক বীরের জাতি। তাদের যে চিরকাল দাবিয়ে রাখা যায় না বা চক্রান্তের জাল বিস্তার করে বিপথগামী করা দুরূহ, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো ৭ নভেম্বর। অসীম সাহস, বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং সময়োচিত পদক্ষেপ তাদের চিরকাল মাথা উঁচু করে রাখতে সাহায্য করে। বীর জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের বীরগাথার অন্যতম বৃহত্তম ঘটনা ৭ নভেম্বর।
৭ নভেম্বরে শিক্ষাই হচ্ছে কোনো আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নত না করা, কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের কাছে হার না মানা। বরং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল চক্রান্তের জাল ছিন্ন করা এবং বীরের জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানো। সেটা এ জাতি সময়মত পেরেছে বলেই তারা স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। সময়োচিত শৌর্য-বীর্য এবং বীরত্বপূর্ণ তৎপরতা দেখাতে পেরেছে বলেই পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
মনে রাখতে হবেÑ আমাদের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয় কিংবা ভারত-পাকিস্তানের মতো চুক্তির ভিত্তিতেও স্বাধীনতা আসেনি। স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। যারা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, সেটা তারা রক্ষা করতেও জানে। জানে বলেই স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় তারা ঠেকিয়ে দিল ভয়াল সুনামির মতো আগ্রাসন, হিমালয়ের মতো ভয়াবহ আক্রমণ ও অগ্নুৎপাতের লেলিহান থাবা।
স্বাধীনতা লাভের পর নানা কারণে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। দেখা দেয় অরাজকতা, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অনিশ্চয়তা। গুপ্ত হত্যা এবং খাদ্য সংকট, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-হাহাকার। যার ফলে দেখা দেয় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। তাতে প্রাণহানি ঘটে কয়েক লাখ লোকের। মানুষ দেখেছে ডাকসু নির্বাচনের নামে কীভাবে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়, যা আগে কেউ কখনো কল্পনাও করা যায়নি। একইভাবে ছিনতাই হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিলুপ্ত হয় চারটি বাদে সকল পত্র-পত্রিকা।
এসব অরাজকতা, অস্থিরতা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করার বদলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কায়েম করা হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল। এরই মাঝে আবার দুঃখজনকভাবে ঘটে যায় আরেক নির্মম ঘটনা। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফলে তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ঘটে রাষ্ট্র ক্ষমতার পট পরিবর্তন।
এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থানের পর সাধারণত সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা চলে যায়। অন্তত যে দলের বিরুদ্ধে ক্যু করা হয় তাদের কেউ ক্ষমতার ধারে কাছেও থাকতে পারে না। পৃথিবীর তাবৎ নাটকীয় উত্থান-পতনে এ দৃশ্যই দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। কেবল তার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতার পাদপীঠে চলে এলেন আওয়ামী লীগের বি-টিম। রাষ্ট্রপ্রধান হলেন বাকশালের ৪নং সদস্য, শেখ মুজিবের দীর্ঘকালের বন্ধু ও সহযোদ্ধা, ঘনিষ্ঠ সহচর খোন্দকার মোশতাক আহমদ। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শেখ সাহেবের মন্ত্রিসভার ১৪ সদস্য। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ বীরউত্তম। এর কিছুদিন পর ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। তাদের দুজনের কেউই ১৫ আগস্টের নায়ক ছিলেন না। থাকলে অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকার কথা। এমনকি ৩ নভেম্বর খালেদ মোর্শরফ কর্তৃক অভ্যুত্থান না ঘটলে ৭ নভেম্বরের ঘটনাও ঘটত না। তাতে জেনারেল জিয়ার পক্ষেও ক্ষমতারোহণ কখনো সম্ভব হতো না।
কেননা, ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল কর্র্তৃক সংঘটিত প্রতিবিপ্লবকে মানতে চাইল না জনগণ। নানা কারণে দেশের মানুষ একে একটি রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দূরনিয়ন্ত্রিত ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করল। নানা মহল থেকে বলা হলো সিকিমের লেন্দুপ দর্জির মতো বাংলাদেশের খালেদ মোশাররফ দেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। জনতা সেটা বিশ্বাস করল এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।
ব্রিগ. খালেদ মোশাররফ তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রধান, সারা ক্যান্টনমেন্ট তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘোষণা করলেন এবং বঙ্গভবন রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হলো। রাষ্ট্রপতি করে আনেন খোন্দকার মোশতাক আহমদের বদলে বিচারপতি আবু সা’দত মোহাম্মদ সায়েমকে। ৩-৬ আগস্ট পর্যন্ত চারদিকে খালেদ মোশাররফের জয়জয়কার। তার পক্ষে তখন নানামুখী প্রচার ও সমর্থন। আওয়ামী লীগের একাংশের মিছিল ও উল্লাস। বিশেষ করে শহীদ মিনার থেকে ধানমন্ডি ৩২নং পর্যন্ত মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই কর্তৃক নেতৃত্ব দেয়া এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের সকল প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের পক্ষে প্রচার। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সমর্থনের ফলে জনতার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। তারা ভাবলো, এ হয়তো ভারতেরই কারসাজি। দেশটা বোধকরি গোয়া বা সিকিমের মতো ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এর প্রেক্ষিতেই ফুঁসে ওঠে জনতা। হতবিহ্বল জনতার মধ্যে সাহস সঞ্চার করে জাসদের গণবাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের। তার সাহসী ভূমিকার জন্যই ৭ নভেম্বর ভোরে সৈনিক-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিতরণ করা হয় হাজার হাজার প্রচারপত্র ও লিফলেট।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের খেলা জন্মলগ্ন থেকেই ছিল, এখনও চলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদানকে কেউ অস্বীকার করেনি, পাশাপাশি এ-ও ঠিক সবসময় ভারতের শাসকরা চেয়েছে বাংলাদেশকে নেপাল-ভুটানের মতো দুর্বল করে রাখতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কখনো দুর্বল থাকেনি। তারা সবসময়ই ৭ নভেম্বরের চেতনায় জাগরিত থেকেছে এবং সকল চক্রান্তের নাগপাশ ছিন্ন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। এ জন্য জাতির কাছে ৭ নভেম্বরের চেতনা হলো সকল আধিপত্যবাদ, সেটা হোক আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশান, ভারতীয়Ñ একে পরোয়া না করে এগিয়ে যাওয়া।
বড় দেশ, বড়জোর বেশি সম্মান, তার বেশি নয়। কিন্তু তল্পিবাহক তাবেদার সুবিধাভোগী কিছু লোক সবসময় জামা ধরে টেনেছে পেছন থেকে। টানে বলেই আমাদের সদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জাগ্রত প্রহরীর মতো সদা পাহারায় নিয়োজিত থাকা প্রয়োজন।
৩ অভ্যুত্থানের খালেদ মোর্শারফ আর ৭ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের নায়ক তৎকালীন জাসদ নিয়ন্ত্রিত গণবাহিনী প্রধান কর্নেল তাহের। আর এ-অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের সুযোগ নিলেন খোন্দকার মোশতাক। ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের আগে পরে তিনি বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন। তিনি ব্রিগে. খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সুযোগ নিলেন হাতে হাতে। বিপ্লবের ঊষালগ্নে এ কথা প্রচারিত হয়ে গেল যে, মোশতাকের হাতে বন্দি চার আওয়ামী লিগ নেতা, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে বের করে এনে তাদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। মোশতাক প্রমাদ গুনলেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হলেন না। জল্লাদ পাঠিয়ে তার চার বন্ধু, চার রাজনৈতিক সহযোগীকে হত্যা করলেন। পথের কাঁটা দূরে সরিয়ে দিলেন। এটি ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা-।
এর পরের আলোচনা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস-এর ‘এ নাইট অফ রিমেম্বার’ প্রবন্ধ থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলোÑ
“৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ ছিল সরকারবিহীন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহম্মদ তখন নামেমাত্র ঐ পদে ছিলেন। মোশতাক তিনদিন কার্যত বন্দিজীবন কাটাচ্ছিলেন। ঐ সময় অভ্যুত্থানের দু’নায়ক ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। যদিও খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল তখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করছিলেন কিন্তু ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পাচ্ছিলো বারবার।”
“নভেম্বরের ১ তারিখে যখন খালেদ, শাফায়াত জামিল ও তাদের সঙ্গীরা ঢাকা স্টেডিয়ামের কাছে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় মিলিত হয়েছিলেন, তখন জাসদ, সর্বহারা পার্টি সৈনিকদের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছিল। সবাই তখন ভাবছিল একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
“মোশতাককে বাধ্য করা হলো মোশাররফকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে। জিয়াউর রহমানকে তখন পদচ্যুত করে অবসরে যেতে বাধ্য করেছিলেন অভ্যুত্থানকারীরা। তাদের প্ল্যান অনুসারে চার নেতাকে মুক্ত করে মুজিববাদী সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন শুনে সকলেই খালেদের প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দেয়। জাসদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সাম্যবাদ’ নামক পত্রিকায় খালেদের অভ্যুত্থান সম্পর্কে বলা হয়Ñ ‘খালেদ মোশাররফ ও তার সঙ্গীরা ক্ষমতায় এসেই দেশের উপর রাশিয়া-ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ ও তার লেজতুল্য মনি-মোশাররফ চক্রটি বেরিয়ে পড়ে শেখ মুজিবের ইমেজ প্রতিষ্ঠার জন্য।’ এ বক্তব্য প্রচারিত হলে খালেদ ভারতের দালাল সাব্যস্ত হন এবং জনমত তার বিপক্ষে চলে যায়।
“মোশতাকের উৎখাতের খবর শুনে উৎফুল্ল আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী দলগুলো ও তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে। ৪ নভেম্বর তারা মুজিব দিবস পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনারসহ বিভিন্ন স্থানে স্মরণসভা করে এবং শহরের নানা স্থানে মিছিল বের হয়। তারা ৩২নং রোডে মুজিবের বাসভবনে গিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে।
“৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হয় হাজার হাজার প্রচারপত্র। এ সময় জাসদ নিষিদ্ধ থাকলেও কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী।
“মধ্যরাতের কিছু পরে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর ভোর রাতের দিকে জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারা অস্ত্রাগার থেকে স্টেনগান-রাইফেলসহ অস্ত্র লুট করল। সকাল পর্যন্ত সারা ঢাকা শহরে ‘সিপাহী বিপ্লব’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাত একটার মধ্যেই সিপাইরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিল। এদের কেউ কেউ ক্রমাগত ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছিল। অন্যরা উত্তেজিত অবস্থায় সেøাগান দিতে দিতে অফিসারদের খুঁজছিল। বেঙ্গল ল্যান্সার হাবিলদার সারোয়ারের নেতৃত্বে একদল জওয়ান গেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে।
“চার দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেন জেনারেল জিয়া। নৈশ পোশাক পরিহিত অবস্থায় উল্লসিত জওয়ানরা জিয়াকে কাঁধে করে নিয়ে গেল ২য় আর্টিলারি হেডকোয়ার্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন জিয়া। নাম না জানা অনেক জওয়ানের সাথে আলিঙ্গন, করমর্দন করলেন তিনি। তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই ফোন করলেন খলিলকে। বললেনÑ আমি মুক্ত।
“জিয়া তার মুক্তিদাতাদের কয়েকজন অফিসারকে তার কাছে আসতে বললেন। তারা হচ্ছেনÑ জেনারেল মীর শওকত, জেনারেল আব্দুর রহমান ও কর্নেল আজিজুল হক। সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি তাদের সহযোগিতা চাইলেন। বললেনÑ আমি রক্তপাত চাই না। কিছুক্ষণ পর তিনি বঙ্গভবনে শাফায়াত জামিলকে ফোন করে বললেনÑ সবকিছু ভুলে সৈনিকদের ঐক্যবদ্ধ কর।
“আগেই জওয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নিয়েছিল। রাতে তারা রেডিওকর্মীদের জানালো যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জনতার বিপ্লব হয়েছে। তখন রেডিওকর্মীরা প্রথমে বুঝতে পারছিল না, তারা কী করবেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন, জওয়ানরা তাদের ভয় দেখাচ্ছে না বরং খালেদ মোশাররফ পরাজয়বরণ করেছেন তখন তারা সকলেই উল্লসিত সৈনিকদের সাথে হাত মেলালেন। সৈন্য এবং সাধারণ মানুষভর্তি কিছু ল্যান্সার ট্যাংক শহরের মাঝে এসে পৌঁছল। সর্বত্র জওয়ান ও সাধারণ মানুষ কোলাকুলি করল। তারা সেøাগান দিলÑ আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ও সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মত এদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। এটা ছিল এক অবিস্মরণীয় রাত।
“রেডিও বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন যে, তিনি সাময়িকভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। সেনাবাহিনীর অনুরোধে এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, সাধ্য অনুযায়ী তিনি তার কর্তব্য পালন করবেন। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ এবং কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে সকলকে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন।
“জিয়ার সংক্ষিপ্ত, আবেগপূর্ণ এবং সময়োচিত ভাষণ সারাদেশে জাতীয়তাবাদের জোয়ার বইয়ে দিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এর আগেও একবার তিনি জনমনে আশার সঞ্চার করেছিলেন। আজও তাই হলো। রেডিওতে যারা তার সিপাহী বিপ্লবের ঘোষণা শুনেছিলেন তারা কেউই সেই অভিজ্ঞতার কথা কখনো ভুলতে পারেন না। আমার এক পুরনো বন্ধু আমাকে পরে বলেছেন, ‘আমি তখন শুয়েছিলাম। যখন রেডিওর ঘোষক বলল, এখন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানÑ তখন যেন সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে আশার আলো জ্বলে উঠল। তার ভাষণ ছিল খুব সাধারণ, আন্তরিক ও বিশ্বস্ত। আমি ভাবি, আমি আজ অবশ্যই কাজে যাব। আমি নিজেকে সেই দিনের জন্য প্রস্তুত করলাম। আল্লাহ্ শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রার্থনা শুনেছিল। বাংলাদেশ আবার নতুন করে জন্ম নিল। আবার জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হল।”
এর পরের অংশটুকু ৮ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সম্পাদকীয় থেকে তুলে ধরা হল :
“গতকল্য ৭ই নভেম্বর যে প্রভাতের সূচনা হইয়াছে তাহা ছিল দেশের বীর সিপাহী ও আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণঢালা আনন্দোচ্ছাসে মুখর। গত ৩রা নভেম্বরের অ্যাডভাঞ্চাস্টি ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পতনের সংবাদ পাওয়া মাত্র রাজধানীর জনতা আনন্দ-কলরবে ছুটিয়া আসিয়াছে রাজপথে। দেখা গিয়াছে লরী ও ট্রাকের অন্তহীন মিছিল। শোনা গিয়াছে মোশতাক জিয়ার নামে ধ্বনি ও কণ্ঠবিদারী সেøাগান। লরী ও ট্রাকের মিছিল বা জমায়েতের সর্বত্র পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া অবস্থান করিয়াছে বীর সিপাহী ও সাধারণ জনগণ। একই সাথে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করিয়াছে। দেশ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সেনাবাহিনীসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের জনগণ কতখানি যে সজাগ সচেতন, তাহা হর্ষোৎফুল্ল সৈনিক জনতার কণ্ঠধ্বনিতে বার বার সমুদ্র-কল্লোলের মত মন্দ্রিত স্বরে বাজিয়া উঠিয়াছে। ... ”
 লেখক : প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন