মহান রব-এর অলৌকিক সৃষ্টির গণনা ও সময়ের দিক থেকে তিনি প্রধান,প্রথম, সেরা, শ্রেষ্ঠতম আবার শেষ, নীচু, নি¤œ, নিকৃষ্টতম শ্রেণি বিভাজন উপাখ্যান দ্বারা বান্দার জন্য নেয়ামত ও অভিশম্পাত নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন।একটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন হলো আরাফার দিন, শ্রেষ্ঠ রাত পবিত্র লায়লা তুল কদর রাত। আবার বছরের বারোটি মাসের মধ্যে রমজান মাস হলো সেরা মাস।এত গেলো বছরের একটি দিন,একটি রাত আর একটি মাসের কথা।কিন্ত শুক্রবার তথা জুমার দিন প্রতি সপ্তাহে একবার করে প্রত্যেক মাসে আসে চার বা পাঁচবার এবং বছরে আসে বায়ান্ন বার।মহান রব-এর ঘোষিত অনুপম মর্যাদার শ্রেষ্ঠ দিন-রাত গুলিতে ইবাদত করার প্রত্যয় প্রকৃত মুমিন মুসলিমগণ-কে তিনশ-তো চৌষট্টি দিনের প্রহর গুনতে হলেও সপ্তাহের পালাক্রমে চলমান শুক্রবার তথা জুম্মা-বার-এর জন্য মাত্র ছয়টি দিন অপেক্ষা করতে হয় যা কিনা ধনী-দরিদ্র,মধ্য-ভিত্ত,সকল মুসলিমের জন্য অগণিত গুণাহ মাফের এবং বর্ণ,বৈষম্যভেদ্য সবার মিলনমেলার দিবসও বটে। উৎকৃষ্ট সময়,ইতিহাস,দর্শন,রহস্য এবং অলৌকিকতার কারণে মহান রব-এর যাবতীয় সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে বর্তমান চলমান প্রক্রিয়া ধাবিত হয়ে কেয়ামত কাল পর্যন্ত এই দিবসটির তাৎপর্য যেনো রহস্যের চাঁদেরই আবৃত থাকবে।মহান রাব্বুল আলামীন মাত্র ছয় দিনে নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেন যা পরিপূর্ণতায় বিকশিত হয় সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার এই মর্মে পবিত্র আল-কোরআনে কয়েকটি আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন-এর ঘোষণা রয়েছে।প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.)-এর সহিহ বর্ণনায় অবগত হওয়া যায় যে, ছয় দিনে জগত সৃষ্টি হয়েছে তা রবিবার থেকে শুরু করে শুক্রবারে শেষ হয়।আবার পৃথিবী ধ্বংস তথা কেয়ামত সংগঠিত হবে ঠিক শুক্রবারে।এই দিনে হযরত (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।এইদিনে হযরত আদম ( আঃ) এবং মাতা হাওয়া (আঃ) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিলো এবং এই দিনেই তাদের দু’জনকে পৃথিবীর দুইটি অঞ্ছলে প্রেরণ করা হয়েছিলো।হযরত আদম (আঃ) কে শাস্তি স্বরূপ রাখা হয়েছিলো শ্রীলংকায় এবং মাতা হাওয়া (আঃ) কে রাখা হয়েছিলো সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে।আবার এইদিনেই তাদের দুজনকে মহান রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করে দিয়ে সান্নিধ্যে করে দিয়েছিলেন।আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃনবী (সাঃ) বলেনঃ সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এ দিন ‘আদাম (‘আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিন সেখান থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে,জুমার দিনই ক্বিয়ামাত সংঘটিত হবে।[ মুসলিম-১৮৬২,আবু দাউদ- ৯৬১] একটি মানুষের জিবনাদ্দশায় যতোগুলো সূর্য উড্ডয়ন- সকাল ভাগ্যে জুটবে তার ভিতরে সবচেয়ে মহিমাপূর্ণ দিনটি সে পাবে শুক্রবার তথা জুমুআ দিন।একটি দিন বলতে সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্তের পর্যন্ত সময়কে বুঝায় এবং যার অর্থ হলো সকল প্রকার ফরয,ওয়াজিব,সুন্নাত,নফল ইবাদতের জন্য এই দিনটি সর্বোৎকৃষ্ট এবং মঙ্গলজনক।আরবী জুমা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো একত্রিত করা যার সাপ্তাহিক প্রধান দিবসের নাম শুক্রবার।পূর্বযুগে এই দিনকে ‘উরু-বা’ বলা হতো।জুমার দিনে চার ওয়াক্ত ফরয নামাজের সাথে যোহরের ফরয নামাজের পরিবর্তে দুই রাকাত সালাত আদায় করা ফরয এবং খুতবা পাঠ ও শোনা ওয়াজিব হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। জুমার সালাত ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ (সা) হিজরত-কালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা পৌঁছান এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার সালাত আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার সালাত।জুমার নামাজের বিষয় পবিত্র কোরআনে সুরা জুমুআ ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে; অর্থাৎ হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামায শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।[সুরা জুমুআ : আয়াত ৯-১০]মহা আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে ১১৪টি সুরার মধ্যে পৃথক ও স্বাতন্ত্র্য একটি সুরা নাযিল করেছেন যা নামকরণ করা হয়ছে জুমুআ নামে।যেমন মহান আল্লাহতায়ালা মুমিনদের উদ্দেশ্য করে শুক্রবারে আযান হবার সাথে সাথে বেচাকেনা বন্ধ সহ দুনিয়াদারী সকল কাজ পরিত্যাগ করে নামাযের উদ্দেশ্যে ছুঁটে আদেশ করেছেন এবং এও বলেছেন নামাজ শেষে আবার তোমরা স্বকর্মকে ছড়িয়ে পড়ে দিনটিতে আল্লাহকে বেশি বেশি স্বরণ করো।আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের মুসলমান সমাজে পশ্চিমা খ্রীষ্ট্রীয়,ইহুদীরা সুকৌশলে শুক্রবার দিনটিকে এমনভাবে বিমুখী-করণ করে রেখেছে যার অন্ত নাই।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সপ্তাহের ছুটির দিন হলো শুক্রবার আর যে কারণে এইদিনে কেনাবেচা সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে।এই উপমাহাদেশে পশ্চিমা বণিকরা কেনাবেচার উদ্দেশ্যে এসে গোড়াপত্তন করেই শেষ হয়নি বরঞ্চ কয়েক শতাধিক বছর শাসনের নামে শোষণ করে ওদের কৃষ্টি-কালচারের বীজ বপন করে যার শিকড়-ডালপালা ছড়িয়ে অধূনা বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।সাড়ে চৌদ্দ-শো বছর পুর্বে যে কথা কোরআনে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আজকের মুসলিম সমাজ শুক্রবারের জুমার আযান হবার পরেও হাঁট বাজারে এতোটা ব্যাস্ত থাকে যে কোরআনকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য এই নামধারী মুসলিমরাই যথেষ্ট স্বাক্ষরে মরিয়া এখন।এই দিনটি আমাদের মুসলমানের জন্য কতোটা মহিমাপূর্ণ যা মহান আল্লাহ সুবাহানাতায়াল্লাহ স্বয়ং খুশি হয়ে আমাদের দান করেছেন।আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল( সাঃ) বলেছেন;আল্লাহ্ আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে জুমার দিন সম্পর্কে সঠিক পথের সন্ধান দেননি বিরোধে লিপ্ত হওয়ার কারণে। তাই ইহুদীদের জন্য শনিবার এবং খৃষ্টান-দের জন্য রবিবার জুম্মু‘আ নির্ধারিত হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে (পৃথিবীতে) আনলেন এবং আমাদেরকে জুম’আর দিনের সঠিক সন্ধান দিলেন। অতএব তিনি শুক্রবার দিন,শনিবার ও রবিবার এভাবে (বিন্যাস) করলেন, এভাবে তারা ক্বিয়ামাতের দিন আমাদের পশ্চাদবর্তী হবে। আমরা পৃথিবীবাসীর মধ্যে শেষে আগমনকারী উম্মাত এবং ক্বিয়ামাতের দিন হব সর্বপ্রথম। যাদের সমগ্র সৃষ্টির সর্বপ্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে। অধস্তন বর্ণনাকারী ওয়াসিল (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে “সকলের মধ্যে”।[সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৮৬৭] মহান রব ইহুদী ও খ্রীস্টানদের ঠিক এই দিনটিকে জুমুআ দিন হিসেবে বরাদ্দ করলেও তাঁরা নিয়েছে শনিবার ও রবিবারকে।স্পষ্ট তাদের জন্য লাণতও নির্ধারন করলেন।অতএব যারা মুসলিম হয়েও ইহুদী,খ্রীস্টানদের মতো শুক্রবারের মর্যাদা দানে গাফিলতি করবে,ওদেরকে অনুসরণ করবে কিংবা ইহুদী,খ্রীস্টানদের মতো এই দিনটিকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করবে তাঁরা ওদেরই দোসর।জুমার দিনে ভাগ্যবান মুসলমানদের ইবাদতের জন্য একটি মিলনমেলা এবং দোয়া কবুলের জন্য।তাই দিনটির পবিত্রতা রক্ষার জন্য এবং মহান আল্লাহর অনুগ্রহ প্রীতির জন্য এই দিনের আমল গুলি পালন করা উচিত।আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার কাছে থাকে। তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়। নির্ধারিত নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহর জন্য কাফ্ ফারা হবে।[ (আবু দাউদ- ৩৪৩]হাদীস-টিতে পাঁচটি আমলের ব্যাখা রয়েছে,যেমন;-১)গোসল করা [বুখারী শরীফের ৮৭৯ নং হাদীসে আবূ সা‘ঈদ খুদ-রী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃআল্লাহ্র রসূল (সাঃ) বলেন জুমার দিনে প্রত্যেক সাবালকেরা জন্য গোসল করা ওয়াজিব।] ২)সুগন্ধি ব্যাবহার করা ৩)কোনো মুসুল্লি কে টপকে সামনে না যাওয়া ৪)নির্ধারিত নামাজ আদায় করা এবং ৫)খুতবার সময় কোনো কথা না বলা।প্রথমত; সুগন্ধি ব্যাবহারের কথা বলা হলেও আমরা অধিকাংশ লোক ইসলামের বিধির বাইরে সেন্ট বা স্প্রে ব্যাবহার করছি।এগুলো কতোটুকু হালাল তা কিন্তু কখনো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করিনা। দ্বিতীয়ত;কোনো মুসুল্লি কে টপকে না যাওয়ার বিষয়টিতে রাসূল(সাঃ)এর নির্দেশকে স্ব-বর্ণিত গরিমা আর অহংকারে নিষ্পেষিত করছি। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও সাবেক প্রভাষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন